ঈমানদারের যুদ্ধ যে কারণে বিরামহীন

ফিরোজ মাহবুব কামাল

শত্রুর ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধ যখন প্রতিক্ষণ, তখন স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে হলে অবশ্যই যুদ্ধ নিয়ে বাঁচতে হয়। মুসলিমের বিরুদ্ধে শয়তান ও তার অনুসারীদের যুদ্ধে কোন বিরতি নাই। শয়তানের সে স্ট্রাটেজি সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা জানেন। এজন্যই তিনি মুসলিমদের উপর শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত ফরজ করেননি, ফরজ করেছেন জিহাদকেও। নামাজ-রোজা পরিত্যাগ করা যেমন হারাম, তেমনি হারাম হলো জিহাদ পরিত্যাগ করা। নবীজীর আমলে আব্দুল্লাহ বিন উবাই এবং তার ৩০০ জন অনুসারী নামাজ-রোজা পরিত্যাগ করার জন্য মুনাফিক হয়নি, তারা মুনাফিকের খেতাব পেয়েছে জিহাদ থেকে দূরে থাকার কারণে।

  

ঈমানের প্রকাশ ঘটে জিহাদের মধ্যে। নামায়-রোজা ও হজ্জ-যাকাত মুনাফিকের জীবনেও থাকতে পারে। কিন্তু মুনাফিকগণ কখনোই জিহাদের ময়দানে থাকে না। সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারেরর সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সেটি হলো:

إِنَّمَا ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا۟ وَجَـٰهَدُوا۟ بِأَمْوَٰلِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّـٰدِقُونَ

 

অর্থ: “ঈমানদার একমাত্র তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনে, অতঃপর আর কোন রূপ সন্দেহ পোষণ করে না, এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করে তাদের সম্পদ ও জীবন দিয়ে, ঈমানের দাবীতে ঐ লোকগুলিই হলো সত্যবাদী।”   

 

উপরিউক্ত আয়াতে ঈমানদার হওয়ার জন্য অপরিহার্য শুধু আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান নয়, বরং অপরিহার্য হলো জান ও মাল দিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার জিহাদ। জিহাদের হাতিয়ার শুধু অস্ত্র নয়, বরং সেটি হলো মু’মিনের কথা, লেখনী ও রাজনীতি। যুগে যুগে বহু মানুষ শহীদ হয়েছে জালেম শাসকের বিরুদ্ধে শুধু সত্য কথা বলা বা লেখনীর কারণে। ইসলামের শত্রু পক্ষের হাতে শহীদ হওযার জন্য তাদেরকে অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে যুদ্ধে যেতে হয়নি, শহীদ হয়েছেন নিরস্ত্র অবস্থায়। যেমন মিশরের ইখওয়ান নেতা হাসানুল বান্না, কুর’আনের বিখ্যাত মোফাচ্ছের শহীদ কুতুব ও ইরানী বুদ্ধিজীবী আলী শরিয়তি শহীদ হয়েছেন স্রেফ সত্য কথা বলা ও লেখনীর জন্য। নবীজীর আমলে হয়রত সুমাইয়া (রা:) এবং তাঁর স্বামী ইয়াছির (রা:) কোন রণক্ষেত্রে শহীদ হননি; তারা শহীদ হয়েছিলেন আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষে মৌখিক সাক্ষ্য দেয়ার কারণে। সেটিই কাফিরদের কাছে হত্যাযোগ্য অপরাধ গণ্য হয়েছে।

 

যারা শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বিরোধী এবং সেবাদাস ভারতের ন্যায় কাফের শক্তির -তারাই প্রকৃত বেঈমান এবং ইসলামের শত্রুপক্ষীয়। তাদের সাথে মুসলিমের কোন রূপ মিত্রতা ও রাজনৈতিক সহঅবস্থান হতে পারেনা। ইসলামে সেটি হারাম। বড়ই বিস্ময়ের বিষয় হলো, এ নিদারুন সত্য কথাটি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পায়নি। তাই অনেক ইসলামপন্থী দল এবং আলেম ইসলামের প্রতিষ্ঠা বিরোধী সেক্যুলারিস্টদের সাথে রাজনৈতিক কোয়ালিশন গড়ে। একটি দেশের জন্য গ্লানিকর বিষয়টি ঘুর্ণিঝড়, ভূমিকম্প বা মহামারিতে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণ নাশ নয়, বরং সেটি হলো কোন দুর্বৃত্ত বেঈমানকে শাসক রূপে মেনে নেয়া এবং রাজস্ব দিয়ে প্রতিপালন দেয়া। মুসলিমদের পতনের শুরু তখন থেকেই যখন থেকে এজিদের ন্যায় দুর্বৃত্তরা রাষ্ট্রের প্রধান তথা চালকের আসনে বসার সুযোগ পেয়েছে। যে আসনে মহান নবীজী বসেছেন সে আসনে এরূপ দুর্বৃত্তদের কি সহ্য করা যায়? মুসলিমদের শুধু নামাজী হলে চলে না, তাদেরকে যুগের এজিদ ও ইমাম হোসেনদেরও চিনতে হয় এবং এজিদ পক্ষে খাড়া হওয়া থেকে বাঁচতে হয়। এখানে ভূল হলে স্রেফ নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত জাহান্নাম থেকে বাঁচাতে পারে না। নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের ন্যায় ইবাদতের মূল লক্ষ্য তো মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ম করা। এবং যে ব্যক্তি তাঁর এজেন্ডার সাথে একাত্ম হয় সে কি কখনো শয়তান পক্ষীয় ব্যক্তি ও দলের সাথে একাত্ম হয়? তাই কোন ঈমানদার ব্যক্তি মুজিবের ন্যায় কোন দুর্বৃত্তকে কখনোই জাতির নেতা,পিতা বা বন্ধু বলতে পারেনা। যারা মহান আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর দ্বীনের বন্ধু নয় তারা মুসলিমদের বন্ধু হয় কি করে? অথচ বাংলাদেশের ন্যায় একটি মুসলিম দেশে সেটিই হচ্ছে।  কাফের শত্রুকে বন্ধু রূপে গ্রহন করাটি কবিরা গুনাহ। বিপুল সংখ্যক বাঙালি মুসলিম সে গুনাহ করেছে ভারতকে বন্ধু রূপে গ্রহন করে। এমন পাপ আযাব ডেকে আনে। বাংলাদেশীদের উপর সে আযাব এসেছে মুজিব-হাসিনার ন্যায় দুর্বৃত্ত জালেমের স্বৈর শাসন রূপে। সম্প্রতি ভারতের অতি পরিচিত এজেন্ট শাহরিয়ার কবির বলেছে, ভারতের ঋণ কোনদিন শোধ করা যাবে না। অথচ প্রকৃত সত্য হলো, কখনোই ভূলবার নয় বাংলাদেশীদের  বিরুদ্ধে  ভারতের নৃশংস অপরাধগুলো। এবং এখনো লাগাতর অব্যাহত রয়েছে সে অপরাধের ধারা। মনিব যদি নিজ ঘরে গুম, খুন, চুরি-ডাকাতি এবং ধর্ষণের রাজত্ব কায়েম করে, তখন তার পোষা ভৃত্যটি স্বচোখে দেখেও তার নিন্দা করে না, বরং নিজের দাসত্ব বাঁচাতে মনিবের প্রশংসায় গদগদ হয়। তেমনি অবস্থা শাহরিয়ার কবিরের ন্যায় ভারতীয় দাসদের।

 

ভারতীয়দের  অপরাধের তালিকাটি বিশাল। ১৯৭১’য়ে ভারতের সেনাবাহিনীর হাতে অধিকৃত হওয়ার পর শুরু হয় নৃশংস লুটতরাজ। তখন সীমান্ত বিলুপ্ত করে দেয় বাংলাদেশের খাদ্য ভারতে নিতে। পাচার শুরু হয় বিদেশ থেকে আসা ত্রাণ সামগ্রীও। সে লুণ্ঠনে কোয়ালিশন গড়ে উঠে ভারতীয় লুটেরাদের সাথে আওয়ামী লীগের দলীয় দুর্বৃত্তদের। তাতে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। মৃত্য হয় লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশীর। ভারত কেড়ে নিচ্ছে পদ্মা, তিস্তাসহ বহু  নদ-নদীর পানি। একাত্তরের যুদ্ধ শেষে ডাকাতি করে নিয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর  হাজার হাজার টাকার অস্ত্র। শাহরিয়ার কবিরের ন্যায় দাসেরা তা নিয়ে তার মনিব দেশ ভারতকে  নিন্দা করতে রাজী নয়।  বরং বাংলাদেশীদের  নসিহত দেয় ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ ও নতজানু থাকতে। শাহরিয়ার কবিরের মত দাসেরাই একাত্তরে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর ভারতবিরোধীদের নির্মূলের লক্ষ্যে নির্মূল কমিটি গড়েছিল। এবং ভারতীয় সেবাদাসদের বিচারক বানিয়ে আদালত বসিয়েছিল।

 

চুরি-ডাকাতি, গুম-খুন, সন্ত্রাস ও স্বৈরাচার অতি গুরুতর অপরাধ। তবে আরো গুরুতর অপরাধ হলো এসব দুর্বৃত্তদের শাস্তি না দিয়ে নেতা, দেশের শাসক বা জাতির পিতার আসনে বসানো। এ অসভ্য কাজ কোন সভ্য জনগণের হতে পারে না। এটি নিরেট বিবেকহীনতা। মানব অসভ্য হয় অর্থের অভাবে নয়, বরং ঈমানহীনতা ও বিবেকহীনতার কারণে। অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামের আগুণে নিক্ষিপ্ত হবে চুরি-ডাকাতি, মানুষ খুন বা ধর্ষণের কারণে নয়, বরং তাদেরকে জাহান্নামে নিবে তাদের বিবেকহীন বিশ্বাস, কর্ম ও আচরন। ঈমানহীনতা ও বিবেকহীনতার কারণেই মানুষ মূর্তি, শাপ-শকুন, দেব-দেবী ও লিঙ্গকে যেমন পূজা করে তেমনি দুর্বৃত্ত জালেমদের দলের নেতা,জাতির পিতা ও দেশের শাসকের আসনে বসায়।   এবং সে ঈমানহীনতা ও বিবেকহীনতাই বাংলাদেশীদের মাঝে বেশী বেশী হচ্ছে। ফলে দেশটি ইতিহাস গড়ছে গুম, হত্যা, ধর্ষণ ও স্বৈরাচারের ন্যায় নানা রূপ অপরাধে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *