বৃহৎ ভূগোলের বিকল্প নাই: ভৌগলিক ক্ষুদ্রতা পরাধীনতা বাড়ায়

 ফিরোজ মাহবুব কামাল

 ইতিহাসের অতি সহজ, সরল ও গুরুত্বপূর্ণ পাঠটি হলো, বৃহৎ ভূগোলেরও বিকল্প নাই। ইজ্জত ও শক্তি নিয়ে বাঁচতে হলে দেশের ভূগোল বাড়াতে হয়। রাশিয়ার অর্থনীতি দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়ে দুর্বল। কিন্তু রাশিয়া বাঁচে বিশ্বশক্তির মর্যাদা নিয়ে। দক্ষিণ কোরিয়ার সে মর্যাদা নাই। কারণ, রাশিয়ার রয়েছে পৃথিবীর মানচিত্রে সর্ববৃহৎ ভূগোল। অথচ দক্ষিণ কোরিয়া হলো একটি ক্ষুদ্র দেশ। বিশ্বজনীন সভ্যতার নির্মাণে বৃহৎ ভূগোলের গুরুত্ব মহান নবীজী (সা:) বুঝতেন। তিনি জানতেন, মুসলিম রাষ্ট্রের সীমান্ত স্রেফ মক্বা-মদিনার ভূমিতে সীমিত থাকলে বিশ্বশক্তি রূপে মুসলিমদের উত্থান অসম্ভব হবে। এবং অসম্ভব হবে দ্বীনের দ্রুত প্রসার। তাই রাষ্ট্র প্রধান হয়েই তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের ভূগোল বাড়াতে লাগাতর জিহাদে মনযোগী হন। তিনি তাঁর সে রাষ্ট্রকে ইন্তেকালের আগেই আজকের বাংলাদেশের চেয়ে ২০ গুণ বৃহৎ মানচিত্র উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর সে সূন্নত অনুসরণ করে উমাইয়া, আব্বাসীয় ও উসমানিয়া খলিফাগণও লাগাতর ভূগোল বাড়িয়েছেন। তারা বিশ্বাস করতেন মুসলিম রাষ্ট্রের ভূগোল বাড়ালে আল্লাহ তায়ালার রহমত নেমে আসে। নবীজী (সা:) সাহবীদেরকে নসিহত করে যান, তারা যেন তৎকালীন বিশ্বশক্তি রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানি কনস্টান্টিনোপল দখলে নেয়। ১৪৫৩ সালে নবীজী (সা:)’র সে স্বপ্ন পূরণ করেন উসমানিয়া খলিফা সুলতান মহম্মদ ফাতেহ। পুরনো সে কনস্টান্টিনোপল হলো আজকের ইস্তাম্বুল।

 

ক্ষুদ্র বাংলাদেশ মানেই ভারতের অধিনস্থ এক পরাধীন বাংলাদেশ –সেটি বুঝতেন খাজা নাজিমুদ্দিন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারর্দি, মাওলানা আকরাম খাঁ, তমিজুদ্দীন খান ও নুরুল আমীনের ন্যায় সে আমলের মুসলিম লীগের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বাঙালি নেতারা। তাই তারা ১৯৪৭’য়ে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানভূক্ত করেছিলেন। সেটিই ছিল বাঙালি মুসলিমদের সর্বশ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত। ফলে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠি রূপে বাঙালি মুসলিমগণ পেয়েছিল শুধু মুসলিম বিশ্বের রাজনীতিতেই নয়, বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলার সুযোগ।  বাঙালি মুসলিমগণ তাদের হাজার বছরের ইতিহাসে কোন দিনই সেরূপ সুযোগ পায়নি। বস্তুত ঢাকায় মুসলিম লীগের জন্ম ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বেশী অবদান ছিল বাঙালি মুসলিমদের। সেদিন সে পাকিস্তান প্রকল্প সফল হওয়ার কারণ, ১৯৪৭’য়ের মুসলিম লীগ নেতাদের কেউই শেখ মুজিবের ন্যায় ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার এজেন্ট ছিলেন না। এবং ছিলেন না কান্ডজ্ঞানহীন ও ইসলামী চিন্তাশূণ্য। বরং তাদের মাঝে ছিল প্রজ্ঞা ও বাঙালি মুসলিমদের জন্য প্রবল কল্যাণ চিন্তা। মুজিবের ন্যায় ভারতের সেবাদাস হওয়া ও ভারতের স্বার্থপূরণ তাদের রাজনীতিতে স্থান পায়নি।  তাদের ছিল ভাষাগত পরিচয়ের উর্দ্ধে উঠে নানা ভাষী মুসলিমদের সাথে বসবাসের প্যান-ইসলামী মুসলিম ভাতৃত্ববোধ।

 

কিন্তু ১৯৭১’য়ে ভারতের কোলে যেসব ইসলামচ্যুৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদী কাপালিকগণ আশ্রয় নিয়েছিল তাদের মাঝে সে ভাতৃত্ববোধ ছিল না। তাই তারা ভারতের বাঙালি ও অবাঙালি হিন্দুত্ববাদীদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু মনে করে -অথচ আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বন্ধ রূপে গ্রহণ করাকে হারাম করেছেন। সে ঘোষণা এসেছে সুরা আল ইমরানের ২৮ নম্বর আয়াতে এবং সুরা মুমতাহানার ১ নম্বর আয়াত। বাঙালি জাতীয়তাবাদী এই ফ্যাসিস্টগণই পাকিস্তানকে পরাজিত করার লক্ষ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ডেকে আনে। এভাবে ভারতীয় সেনাদের জন্য সুযোগ করে দেয় ব্যাপক লুটতরাজের। ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের প্রতি অঙ্গীকার না থাকার কারণে পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠি রূপে স্বাধীন থাকাটি তাদের কাছে ভাল লাগেনি। ভাল লাগেনি অখণ্ড পাকিস্তানের শরীক রূপে বিশ্ব রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার কাজটিও। বরং ভাল লেগেছে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের গোলামী। মুজিব ও হাসিনার আমলে বাংলাদেশের বুকে যেরূপ গুম, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চুরিডাকাতি ও ফ্যাসিবাদের তান্ডব হয়েছিল -তা তো এসব ভারতসেবী কাপালিকদেরই সৃষ্টি।

 

৫৭টি মুসলিম দেশের প্রতিটি ঘর যদি প্রাসাদ হয়, মাথাপিছু আয় যদি ২০ গুণ বৃদ্ধিও পায় এবং  নির্মিত হয় বহু হাজার মাইল সড়ক ও শত শত ব্রিজ, শত শত কল-কারখানা -তবুও মুসলিমগণ ভারতীয় হিন্দুদের থেকে দুর্বলই থাকবে। কারণ হিন্দুগণ ৫৭ টুকরায় বিভক্ত নয়। বিভক্তির কারণে যেরূপ শক্তিহানী ও ইজ্জতহানী হয় -তা সম্পদ, রাস্তাঘাট বা কলকারখানা গড়ে পূরণ করা যায় না। বাংলাদেশের ন্যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম দেশগুলির মূল দুর্বলতা তো ক্ষুদ্র ভূগোলে। সে দুর্বলতার পরিণাম থেকে বাঁচাতেই মহান আল্লাহতায়ালা কোন মুসলিম দেশকে ভাঙ্গাকে হারাম করেছেন। এবং একতাকে ফরজ করেছেন। যারা ইসলাম থেকে দূরে সরেছে তারা দূরে সরেছে মহান আল্লাহতায়ালার এ বিধান থেকে। তাই উসমানিয়া খেলাফত, পাকিস্তান ও সূদানের ন্যায় বৃহৎ মুসলিম দেশগুলি ভাঙ্গা বিধর্মী কাফির ও ইসলামচ্যুৎ জাতীয়তাবাদীদের কর্ম হলেও কখনো সেটি ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের সমর্থন পায়নি। একাত্তরে তাই পূর্ব পাকিস্তানের কোন ইসলামী দল, কোন প্রসিদ্ধ আলেম এবং কোন পীর পাকিস্তান ভাঙ্গাকে সমর্থন করেনি। এ কাজ ছিল জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট, কম্যুনিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও হিন্দুত্ববাদীদের।      

 

ঈমানদারের কাছে গুরুত্ব পায় সত্যিকার মুসলিম পরিচয় নিয়ে বেড়ে উঠা। মুসলিম জীবনে এটিই হলো মূল এজেন্ডা। এ এজেন্ডা পূরণে ব্যক্তির সাফল্য কতটুকু -মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে রোজ হাশরের বিচার দিনে সেটিরই হিসাব দিতে হবে। ভাষা, ভৌগলিক ও গোত্রীয় পরিচয় সেদিন মূল্যহীন হবে। অথচ আজ মুসলিমদের সম্পদ, মেধা, শ্রম ও রক্ত ব্যয় হচ্ছে নিজেদের ভাষা, ভূগোল ও গোত্র-ভিত্তিক পরিচয় বাড়াতে। এ লক্ষে তারা যুদ্ধ করছে এবং বিপুল সংখ্যায় প্রাণও দিচ্ছে। একাত্তরে বাঙালি মুসলিমগণ ভাষাভিত্তিক সে পরিচয় বাড়াতে ভারতীয় কাফেরদের সাথে নিয়ে এক প্রকাণ্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ লড়েছে। এটি ছিল মহান আল্লাহ তায়ালার দেয়া জানমালের প্রকাণ্ড খেয়ানত। এমন খেয়ানতে কি মহান আল্লাহ তায়ালা কখনো খুশি হন? একাজে  খুশি হয় তো শয়তান ও তার কাফের অনুসারীরা।

 

সভ্য মানুষদের ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চল ভিন্ন ভিন্ন হলেও তারা একত্রে শান্তিতে সহ-অবস্থান করে। এটিই হলো মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ গুণ। সভ্য ও শক্তিশালী রাষ্ট্র তো সে পথেই নির্মিত হয়। তাই ঈমানদারকে তাই শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাতে সিদ্ধ হলে চলে না, তাকে অবশ্যই অন্যদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের গুণটিও অর্জন করতে হয়। এরূপ ভাতৃসুলভ গুণ অর্জনটি ইসলামে  ফরজ। তাই ঈমানদার শুধু অন্য ভাষী, অন্য বর্ণ ও অন্য অঞ্চলের মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজই পড়ে না; রাষ্ট্রও নির্মাণ করে। সেটিই তো নবীজী ও সাহাবাদের সূন্নত।  মুসলিম মাত্রই তাই কসমোপলিটান এবং একে অপরের ভাই। মুসলিমদের পতনের শুরু তো তখন থেকেই যখন থেকে বিলুপ্ত বা দুর্বল হয়েছে সে মহান সূন্নত এবং মুসলিমগণ ভেসে গেছে জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদ, বর্ণবাদ ও আঞ্চলিকতার স্রোতে।  ভাষা, বর্ণ, অঞ্চলের নামে স্রোতে ভাসা, মুসলিমদের মাঝে বিভক্তি গড়ে এবং সমাজকে অশান্ত ও সংঘাতময় করা মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে অতি অপছন্দের। ইসলামে এটি হারাম।

 

সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহ তায়ালা নানা বর্ণ, ,নানা গন্ধ ও নানা আকৃতির বিচিত্র ফুল দিয়ে এ পৃথিবীকে সাঁজিয়েছেন। তেমনি সাঁজিয়েছেন নানা বর্ণ, নানা ভাষা, নানা আকৃতির মানুষকে দিয়েও। এরূপ ভিন্নতা কখনোই বিভক্তি গড়ার জন্য নয়। পৃথিবীকে এরূপ বৈচিত্রময় করাই মহান আল্লাহ তায়ালা’র রুচি ও অভিপ্রায়। মুসলিমের কাজ হলো মহান স্রষ্টার সৃষ্ট সে বৈচিত্রকে সম্মান করা; এবং সেটিকে বিভক্তি ও নাশকতার কাজে ব্যবহার করা থেকে দূরে থাকা। বিভক্তি ও নাশকতার কাজ তো শয়তানের। তাছাড়া নানা বৈচিত্রের মাঝে যে কসমোপলিটান ভাতৃত্ব ও সহ-অবস্থান সেটিই সমাজ ও রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধ ও সুন্দরতম করে। সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা তো নির্মিত হয় সে পথেই। সেটি দেখা গেছে মুসলিমদের গৌরব কালে। সেদিন তুর্কি, কুর্দি, আরব, মুর, ইরানী, হাবসী সবাই একত্রে শান্তিতে বসবাস করেছে। তারা জন্ম দিয়েছে বিশ্বশক্তির। তাই সে গৌরব যুগের মুসলিমগণ যেরূপ নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, সমৃদ্ধি ও ইজ্জত নিয়ে বসবাস করেছে, সেটি আজ কল্পনাও করা যায়না। গোত্রবাদী, বর্ণবাদী ও জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে সেরূপ সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণ করা অসম্ভব। ১৯৪৭-পূর্ব ভারতে তেমন একটি প্যান-ইসলামিক চেতনা প্রবল ভাবে বেড়ে উঠেছিল মুসলিমদের মাঝে। ফলে ইংরেজ ও হিন্দুদের বাধা সত্ত্বেও তারা প্রতিষ্ঠা করেছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের। কিন্তু শয়তানী শক্তির কাছে সেটি ভাল লাগেনি। ফলে তাদের হাতে ১৯৪৭ থেকেই শুরু হয় পাকিস্তান বিনাশের কাজ।  ১৯৭১’য়ে সে শয়তানি প্রকল্পে যোগ দেয় শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি কাপালিকগণও। ফলে তারা বিজয়ী হয়েছে এবং অধিকৃতি বেড়েছে ভারতের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *