পরিশুদ্ধ ব্যক্তি ও রাষ্ট্র নির্মাণের রোডম্যাপ

ফিরোজ মাহবুব কামাল

ঈমানদার হওয়ার পুরস্কারটি যেমন বিশাল, তেমনি বিশাল হলো তাঁর উপর অর্পিত দায়ভারটি। তাকে প্রতিক্ষণ বাঁচতে হয় মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশিত পবিত্র মিশন নিয়ে। সে মিশনের মূল কথা: প্রতিটি মানুষ আমৃত্যু জিহাদে লিপ্ত হবে সত্য ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠায় এবং মিথ্যা ও অবিচারের নির্মূলে। সৈনিকের জীবনে যেমন যুদ্ধ থাকে, তেমনি বিরামহীন যুদ্ধ থাকে মুমিনের জীবনেও। মুমিনের সে যুদ্ধই হলো পবিত্র জিহাদ। আল্লাহ তায়ালার কাছে সবচেয়ে প্রিয় কারা -সে  প্রশ্নের জবাবে সুরা সাফ’য়ের ৪ নম্বব আয়াতে বলা হয়েছে,

إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلَّذِينَ يُقَـٰتِلُونَ فِى سَبِيلِهِۦ صَفًّۭا كَأَنَّهُم بُنْيَـٰنٌۭ مَّرْصُوصٌۭ ٤

অর্থ: “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন যারা তাঁর পথে জিহাদ করে সিসাঢালা দেয়ালের ন্যায় সারিবদ্ধ ভাবে।”

জিহাদই হলো ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের বুকে মিথ্যার নির্মূল ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার হাতিয়ার। মিথ্যার নির্মূলের জিহাদটি না হলে মিথ্যার স্রোতে ভেসে যেতে হয়।  মিথ্যার জোয়ারে ভেসে সাধারণ জনগণও তখন মিথ্যাবাদীতে পরিণত হয়। এমন মিথ্যাবাদী জনগণই ফিরাউনকেও খোদা বলেছে এবং মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্র হত্যাকারী ফ্যাসিস্ট, দুর্বৃত্ত পালনকারী এবং ভারতের দালালকে জাতির পিতা, নেতা ও বন্ধু বলেছে। ভারত বাংলাদেশীদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, একাত্তরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে, ২ লাখ বাঙালি রমনীকে ধর্ষণ করেছে, পাকিস্তানীরা বাঙালির মুখের ভাষাকে কেড়ে নিয়েছে -এরূপ অসংখ্য মিথ্যাকেও তারা প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। অপর দিকে দুর্বৃত্তদের নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার কাজটি না হলে দেশে প্লাবন আসে গুম, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চুরিডাকাতি ও ভোটডাকাতির ন্যায় নানা রূপ অপরাধের। জিহাদশূণ্যতার কারণে বাংলাদেশের জনগণ যেমন মিথ্যার স্রোতে ভেসে ইতিহাস গড়েছে, তেমনি ইতিহাস গড়েছে দুর্বৃত্তির প্লাবনে ভেসে। ফলে বাংলাদেশ দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হওয়ার রেকর্ড গড়েছে।

যে দেশে বিরামহীন জিহাদটি দুর্বৃত্তির নির্মূলে এবং সুবিচারের প্রতিষ্ঠায়, একমাত্র সেদেশেই বিজয় আসে ইসলামের এবং নির্মিত হয় সভ্যতর ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র। পরিশুদ্ধ ব্যক্তি ও রাষ্ট্র নির্মাণের সেটিই হলো কুর‌’আনী রোডম্যাপ। ঈমানদার ব্যক্তি তখন বেড়ে উঠে জান্নাতের যোগ্য রূপে। মুসলিম রাষ্ট্রে তখন প্রতিষ্ঠা পায় অনাবিল শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি। ইসলাম যে শান্তির ধর্ম একমাত্র তখনই সেটি প্রমাণিত হয়। তখন মুসলিমদের মাঝে সৃষ্টি হয় জান্নাতের পথ চেনা এবং সে পথে চলার সামর্থ্য। রাষ্ট্র তখন পরিণত হয় জান্নাতের বাহনে। তাই জিহাদ নিয়ে বাঁচাই মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মিশন। যেদেশে সে জিহাদ নাই, সে দেশে লক্ষ লক্ষ মসজিদ, হাজার হাজার মাদ্রাসা এবং কোটি কোটি নামাজী থাকতে পারে, কিন্তু সে দেশে কখনোই গড়ে উঠে না পরিশুদ্ধ ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র। বাংলাদেশের ন্যায় জিহাদশূণ্য মুসলিম দেশগুলি তো তারই উদাহরণ।

মুসলিম জীবনের মূল মিশনটি স্রেফ নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত নিয়ে বাঁচা নয়; বরং ৫ ওয়াক্ত নামাজ, মাহে রমযানের মাসব্যাপী রোজা এবং হজ্জ-যাকাতের মূল লক্ষ্য হলো ব্যক্তিকে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ম করা। মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা হলো তার সার্বভৌমত্ব ও শরিয়তী আইনের যেমন প্রতিষ্ঠা, তেমনি দুর্বৃত্তির নির্মূল এবং সুবিচারের প্রতিষ্ঠা। যে ব্যক্তি ব্যর্থ হয়েছে সে এজেন্ডার সাথে একাত্ম হতে, বুঝতে হবে সে বস্তুত ব্যর্থ হয়েছে ঈমানদার হতে। এবং যারা সে এজেন্ডার সাথে একাত্ম হয়, তাদের জীবনে আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব, তাঁর শরিয়তী আইন এবং দুর্বৃত্তির নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জিহাদও শুরু হয়ে যায়। তখন বিজয়ী হয় মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা, প্রতিষ্ঠা পায় ইসলামী রাষ্ট্র এবং নির্মিত হয় সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা -যেমনটি নবীজীর আমলে দেখা গেছে। কিন্তু যারা নিয়মিত নামাজ-রোজা পালন করেও মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাই’য়ের ন্যায় ব্যর্থ হয় মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ম হতে এবং ব্যর্থ হয় জিহাদে শামিল হতে, তখন বুঝতে হবে ব্যর্থ হয়ে গেছে তাদের নামাজ-রোজাসহ সকল ইবাদত।

পবিত্র কুর’আনের ঘোষণা: “ইন্নাস সালাতা তানহা আনিল ফাহশা ওয়াল মুনকার।” অর্থ: “নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লিলতা ও দুর্বৃত্তি থেকে দূরে রাখে।” ব্যক্তির নামাজ কতটা সফল হচ্ছে সেটি বুঝার তাই সুস্পষ্ট মানদন্ড আছে। সেটি বুঝা যায় তার অশ্লিলতামুক্ত ও দুর্বৃত্তিমুক্ত চরিত্র থেকে। কিন্তু যে দেশে লক্ষ লক্ষ মসজিদ এবং কোটি কোটি নামাজী, সে দেশে যদি গুম, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস ও স্বৈরাচারের প্লাবন সৃষ্টি হয়, তখন কি বুঝতে বাকি থাকে কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে কতটুকু ব্যর্থ হচ্ছে দেশবাসীর নামাজ?  নামাজ-রোজা পালন করেও কেউ যদি সূদ-ঘুষ খায়, প্রতারণা করে এবং মিথ্যা বলে তবে কি সে নামাজের কোন মূল্য থাকে? জাল নোটের যেমন বাজারে কোন মূল্য থাকে না, তেমনি মহান আল্লাহতায়ালার কাছে মূল্য থাকেনা জাল নামাজের। ফলে নামাজের নামে জাল নামাজের সংখ্যা বাড়িয়ে লাভ কি?

মহান আল্লাহ তায়ালা নামাজ-রোজার সংখ্যা দেখেন না, বরং দেখেন সে নামাজ-রোজা ব্যক্তির জীবনে কতটা সৎ কর্মের জোয়ার আনলো সেটি। দুর্বৃত্তদের নির্মূলে এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় কে কতটা জান, মাল, শ্রম ও মেধার বিনিয়োগ করলো, রোজ হাশরের বিচার দিনে সেটিই অধিক গুরুত্ব পাবে। বস্তুত জিহাদ নিয়ে বাঁচাতে ব্যক্তির মাঝে গড়ে উঠে মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মাগফিরাত লাভ ও জান্নাতের জন্য যোগ্য রূপে গড়ে উঠার সামর্থ্য। মুসলিমগণ যেহেতু এমন একটি পবিত্র মিশন নিয়ে বাঁচে – মহান আল্লাহ তায়ালা এজন্যই সুরা আল-ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে তাদেরকে সর্বশ্রষ্ঠ উম্মত বা জনগোষ্ঠি রূপে আখ্যায়ীত করেছেন। বলা হয়েছে,

كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِٱلْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ ٱلْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِٱللَّهِ

অর্থ: “তোমরাই হলে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত; তোমাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে সমগ্র মানব জাতির জন্য। তোমরা এ জন্য শ্রেষ্ঠ যে, তোমরা প্রতিষ্ঠ দাও ন্যায়ের এবং নির্মূল করো দুর্বৃত্তির এবং তোমার ঈমান এনেছো আল্লহর উপর‍।”   

এ পবিত্র মিশন নিয়ে বাঁচার কল্যাণ যে কতটা বিশাল -সেটি প্রমাণ করেছেন মহান নবীজী (সা:) এবং তাঁর সাহাবাগণ। বস্তুত সে মিশন নিয়ে বাঁচার কারণেই তাদের হাতে গড়ে  উঠেছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র ও সভ্যতা। মুসলিমগণ পরিণত হয়েছে বিশ্বশক্তিতে। এবং সেরূপ একটি রাষ্ট্র নির্মাণ ও পরিচালনার মাধ্যমে নবীজী ও তাঁর খোলাফায়ে রাশেদাগণ পরবর্তী মুসলিমদের জন্য পথ দেখিয়েছেন কিরূপে সে মিশন নিয়ে বাঁচতে হয় ও বেড়ে উঠতে হয়।

 

২. মুসলিমগণ বাঁচছে নবীজী ইসলাম ছাড়াই

আজকের মুসলিমগণ ইতিহাস গড়েছে সীমাহীন ব্যর্থতা ও কদর্যতায়। এর কারণ, যে ইসলাম নিয়ে তারা বাঁচছে সেটি আদৌ নবীজী (সা:)’র ইসলাম নয়। মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশিত পথ ছেড়ে তারা বাঁচছে শয়তানের এজেন্ডা নিয়ে। শয়তানের এজেন্ডা হলো ভাষা, বর্ণ, আঞ্চলিকাতার নামে মুসলিমদের বিভক্ত করা ও সে বিভক্তি নিয়ে কলহ-বিবাদে লিপ্ত রাখা। মুসলিমদের দুর্বল রাখার এ হলো শয়তানী কৌশল। মুসলিমগণ শয়তানের সে কৌশলকেই নিজেদের রাজনীতি ও সংস্কৃতি বানিয়ে নিয়েছে। মুসলিমদের  উদ্দেশ্যে শয়তানের রোডম্যাপটি হলো, অখণ্ড মুসলিম ভূমিতে ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চলের ভিন্নতা থাকলে সে ভিন্নতার পরিচয় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্র গড়ে তোলা। ১৯৭১’য়ে তাই বাঙালি মুসলিমদের কাছে গুরুত্ব পায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙ্গে ক্ষুদ্রতর বাংলাদেশ নির্মাণ। সে লক্ষ্যে তারা পৌত্তলিক কাফিরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে। এমন কাজ কি কোন ঈমানদারের হতে পারে? বাঙালি মুসলিমদের ঘাড়ে যেভাবে চেপে বসেছিল মুজিব ও হাসিনার ন্যায় নৃশংস ফ্যাসিস্টদের দুঃশাসন -তার কারণ তো একাত্তরের রাজনৈতিক ভ্রষ্টতা।

শয়তানের এজেন্ডা কাফিরদের জন্য ভিন্নতর। মুসলিমদের মাঝে বিভক্তি চাইলেও কাফিরদের জন্য চায় ভূ-রাজনৈতিক একতা। তাই অখণ্ড ভারতীয় ভূখণ্ডে একত্রে বসবাস করছে বাঙালি, বিহারী, পাঞ্জাবী, গুজরাতী,মারাঠি, তামিল এরূপ নানা ভাষা ও নানা বর্ণের শয়তানের হিন্দুত্ববাদী খলিফাগণ। এভাবে জন্ম দিয়েছে শক্তিশালী এক হিন্দু রাষ্ট্রের। অথচ এরূপ একতাবদ্ধ হওয়াটি হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় বিধান নয়। অথচ মুসলিম উম্মাহ বিভক্ত হয়েছে ৫৭টি রাষ্ট্রে। অথচ মুসলিমদের উপর একতাবদ্ধ হওয়াটি ফরজ; এবং বিভক্ত হওয়া হারাম। মহান আল্লাহ তায়ালা বিভক্ত হওয়ার বিরুদ্ধে তীব্র হুশিয়ারিটি জানিয়েছেন সুরা আল-ইমরানের ১০৩ নম্বর আয়াতে। বলেছেন, “তোমরা  আল্লাহর রশি তথা কুর’আনকে আঁকড়ে ধরো এবং  পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” মুসলিমদের মাঝে বিবাদ থাকতেই পারে, কিন্তু ভৌগলিক বিভক্তি তার সমাধান নয়। বরং এরূপ বিভক্তি যে মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ভয়ানক আযাব ডেকে আনবে, সে হুশিয়ারিটি শোনানো হয়েছে সুরা আল-ইমরানের ১০৫ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে,

وَلَا تَكُونُوا۟ كَٱلَّذِينَ تَفَرَّقُوا۟ وَٱخْتَلَفُوا۟ مِنۢ بَعْدِ مَا جَآءَهُمُ ٱلْبَيِّنَـٰتُ ۚ وَأُو۟لَـٰٓئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌۭ

অর্থ: “এবং তোমরা তাদের মত হয়োনা যারা বিভক্ত হলো এবং তাদের কাছে সুস্পষ্ট বয়ান আসার পরও পরস্পরে মতভেদ গড়লো; এরাই হলো তারা যাদের জন্য রয়েছে বিশাল আযাব।”

ক্ষুদ্রতা শুধু পরাজয় ও গোলামীই বাড়াতে পারে। বিজয় ও গৌরব নয়। তাই একাত্তরে বাঙালি মুসলিমদের উপর চেপে বসেছিল ভারতের গোলামী। এটিই হলো একাত্তরের প্রকৃত নাশকতা। ভারতসেবীরা সেটিকে স্বাধীনতা বলে। মুসলিমগণ অতীতে তখনই বিজয়, স্বাধীনতা ও গৌরব পেয়েছে -যখন তারা আরব, তুর্কি, কুর্দি, ইরানী, মুর এসব ভিন্নতা ভূলে এক উম্মতে ওয়াহেদা সৃষ্টি করেছে। তখন সাহায্য এসেছ মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *