অধ্যায় উনত্রিশ: ভারতের নাশকতা
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on December 29, 2018
- ই-বুকস
- No Comments.
এজেন্ডাঃ অখণ্ড ভারত নির্মাণ
পাকিস্তান ভাঙ্গাটি ভারতের কাছে এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে,ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির কাছে একাত্তরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা চিহ্নিত হয় ভারতের জন্য স্বাধীনতা লাভের দ্বিতীয় পর্ব রূপে।পাকিস্তান ভাঙ্গার পর মনের সে সে তীব্র আনন্দটিই ইন্দিরা গান্ধি ১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারি লক্ষৌতে এক বক্তৃতায় প্রকাশ করেন।আনন্দটি ছিল হাজার সালের বদলা নেয়ার।পরের দিন ইন্দিরার সে উল্লাসভরা উক্তিটি ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় বিশাল শিরোনামায় ছাপা হয়।ফলে প্রমানিত হয়,পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাত্তরের যুদ্ধটি ছিল ভারতের নিজস্ব যুদ্ধ।সে যুদ্ধের লক্ষ্য আদৌ স্বাধীন ও শক্তিশালী বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ছিল না।সেটিই প্রকাশ পেয়েছে ইন্দিরা গান্ধির সেদিনের বক্তব্যে। তিনি একই রূপ আনন্দ জাহির করেছেন ভারতীয় পার্লামেন্টের বক্তৃতায়।আনন্দ জাহির করেছে অন্যান্য নেতানেত্রীগণও।ভারতীয় হি্ন্দুদের কাছে স্বাধীনতার অর্থ অখণ্ড ভারত এবং সে ভারতের উপর হিন্দু শাসন।সে অখণ্ড ভারতে স্বাধীন পাকিস্তানের যেমন স্থান নেই,স্বাধীন বাংলাদেশেরও স্থান নেই।ফলে প্রতিবেশী দেশের স্বাধীনতাকে পদদলিত করাই তাদের নীতি।একাত্তরে বাংলাদেশ একটি ভিন্ন মানচিত্র,ভিন্ন পতাকা ও ভিন্নজাতের একটি জাতীয় সঙ্গিত পেয়েছে ঠিকই;কিন্তু ভারতীয় বাহিনীর যুদ্ধজয়ের ফলে হারিয়েছে সাংস্কৃতিক,অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব।সে স্বার্বভোমত্ব হারানোর সুস্পষ্ট আলামতটি হলো,ভারতের সাথে তাজু্দ্দীনের ৭ দফা এবং মুজিবের ২৫ সালা গোলামী চুক্তি স্বাক্ষর। আরো আলামত হলো,বাংলাদেশের বাজারে ভারতীয় পণ্যের মুক্ত প্রবেশ,এবং সাংস্কৃতিক ময়দানে হিন্দুস্থানী টিভি প্রগ্রাম,ফিল্ম ও বই-পুস্তকের অবাধ দৌরাত্ম।ভারত এখন আর বাংলাদেশকে তার রাজনৈতিক,সামরিক ও সাংস্কৃতিক দখলদারির বাইরে যেতে দিতে রাজি নয়।এসবই হলো একাত্তরের অর্জন।
ভারতের বর্তমান শাসক দল হলো ভারতীয় জনতা পার্টি তথা বিজেপি।বিজেপি’র অঙ্গ দল হলো রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ তথা আর.এস.এস। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বর্তমান অবস্থানে উঠে এসেছেন এ সংগঠন থেকে।বিজেপির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক (২০১৫ সালের)রাম মাধাবও এক সময় আর.এস.এস’য়ের মুখপাত্র ছিলেন।এটি এখন কোন গোপন বিষয় নয় যে,রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের মূল এজেন্ডা হলো অখণ্ড ভারত নির্মাণ এবং সে ভারতের প্রতিরক্ষা দেয়া।সে লক্ষ্যে দলটির নারী ও পুরুষ নেতাকর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।আর.এস.এস’য়ের কেন্দ্রীয় দফতর অবস্থিত নাগপুরে;এ দফতরের দেয়ালে শোভা পায় অখণ্ড ভারতের একটি বিশাল মানচিত্র। সে মানচিত্রে বাংলাদেশে বলে কোন দেশ নাই,পাকিস্তান বলেও কোন দেশ নাই।আছে শুধু অখণ্ড ভারত।দলটির নেতাকর্মীদের সেটিই ভিশন। আল জাজিরা ইংরেজী টিভি চ্যানেলের উপস্থাপক মেহেদী হাসান নাগপুরে গিয়ে সে মানচিত্রটি দেখতে পান।বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধাবকে আল জাজিরা’র একটি প্রোগ্রামে তিনি প্রশ্ন করেন,কেন এ মানচিত্রে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নাম নেই? রাম মাধাব অকপটে বলেন,আর.এস.এস চায় অখণ্ড ভারত।-(হেড টু হেড,আল জাজিরা টিভি চ্যানেল,ইংরেজী,২৬/১২/১৫)। লক্ষ্য যখন অখণ্ড ভারত নির্মান;সে রাজনীতিতে কি স্বাধীন বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের জন্য কোন স্থান থাকে?
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও তার নেতা গান্ধি,নেহেরু ও বল্লব ভাই প্যাটেলেরও লক্ষ্য ছিল অখণ্ড ভারতের প্রতিষ্ঠা।সে অখণ্ড ভারতের নির্মাণে তারা ১৯৪৭ সাল থেকেই একের পর একটি দেশ গ্রাস করেছে।১৯৪৮ সালে গ্রাস করেছে কাশ্মীর,হায়দারাবাদ,গোয়া ও মানভাদার এবং ১৯৭৪ সালে গ্রাস করে সিকিম।তবে তাদের সমরনীতি বা রাজনীতির এখানেই শেষ নয়।প্রতিবেশী দেশের উপর এরূপ সামরিক আগ্রাসন নিয়ে আজকের ক্ষমতাসীন বিজেপীও ক্ষমতাচ্যুৎ কংগ্রেসের মাঝে দ্বিমত নাই।ভারতের বিভক্তি রুখতে ১৯৪৭ সালে তারা ব্যর্থ হয়েছিল মুসলিম লীগ নেতা কায়েদে আযম মহাম্মদ আলী জিন্নাহর অপ্রতিরোধ্য নেতৃত্বের কারণে।তবে সেদিন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা রুখতে ব্যর্থ পেলেও অখণ্ড ভারত নির্মানের স্বপ্নটি কোন কালেই তাদের মগজ থেকে বিলুপ্ত হয়নি।তবে সে লক্ষ্য পূরণে সবচেয়ে বড় বাধা হলো শক্তিশালী পাকিস্তান।পাকিস্তান খণ্ডিত হলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরোগুলোকে কবজা করার কাজটি সহজতর হয়।সমগ্র উপমহাদেশের উপর কর্তৃত্ব প্রয়োগে ভারতের স্বাধীনতাটি তখন বাড়ে। তাই ১৯৪৭’য়ের পর থেকে ভারতীয় নীতি হয় প্রতিবেশী পাকিস্তানকে খণ্ডিত করা এবং বিচ্ছিন্ন টুকরোকে ধীরে ধীরে ভারতীয় দখলদারিতে আনা।সে লক্ষ্যে ভারত বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে “জিয়ে সিন্ধ” আন্দোলনের নেতা জি.এম.সৈয়দের উপর।লক্ষ্য,পাকিস্তানে থেকে বিচ্ছিন্ন স্বাধীন সিন্ধু দেশের প্রতিষ্ঠা।সীমান্ত প্রদেশে পুঁজি বিনিয়োগ করে “সীমান্ত গান্ধি” নামে পরিচিত কংগ্রেস নেতা আব্দুল গাফ্ফার খানের নেতৃত্বে স্বাধীন পখতুনিস্তান প্রতিষ্ঠায়।পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার কাজে ময়দানে নামায় শেখ মুজিবকে।এখনও চালিয়ে যাচ্ছে বেলুচিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার কাজ।মুহাজির অধ্যুষিত পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ শহর করাচী এবং পাশ্ববর্তী হায়দারাবাদকে নিয়ে চেষ্টা চালায় স্বাধীন মুহাজিরস্তান প্রতিষ্ঠায়। অনেকে অভিমত,ভারত এ লক্ষ্যে পার্টনার রূপে বেছে নিয়েছে লন্ডন প্রবাসী মুহাজির নেতা আলতাফ হোসেন ও তার সংগঠন মুহাজির কাওমী মাহাজ (এমকিউএম)কে।
এমন আগ্রাসী চেতনা নিয়ে নিজ সীমান্তের পাশে স্বাধীন ও শক্তিশালী দেশের প্রতিষ্ঠায় ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধ করবে বা রক্ত দিবে -সেটি কীরূপে আশা করা যায়? ভারতের আধুনিক ইতিহাস তো পূর্ণ প্রতিবেশী দেশের স্বাধীনতা হরণের যুদ্ধ ও ষড়যন্ত্রে।স্বাধীনতার যুদ্ধ তো প্রতিদেশেই সেদেশের জনগণের নিজস্ব যুদ্ধ। রক্তের কোরবানি পেশ করতে হয় নিজেদের।অন্যরা বড়জোর অর্থ দেয়,অস্ত্র দেয়,প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেয়।অন্যরা কখনো কি রক্তও দেয়? বাঘ-ভালুক কখনোই অন্যজীবের জন্য শিকার ধরে না।ধৃত শিকারে কাউকে অংশ দেয়না।সাম্রাজ্যবাদীদেরও সেটিই রীতি।তারা যখন যুদ্ধ লড়ে ও প্রাণ দেয়,বুঝতে হবে সেটি নিজেদের জন্যই লড়ছে।১৭৫৭সালে পলাশীর প্রাঙ্গনে নবাব সিরাজদ্দৌলার বিরুদ্ধে ইংরেজদের যুদ্ধটি ছিল তাদের নিজেদের যুদ্ধ,নবাব সিরাজদ্দৌলার বদলে মীর জাফরের হাতে ক্ষমতা দেয়ার উদ্দেশ্যে নয়।একাত্তরে ভারতের নীতিও সেটিই ছিল।তাই পাকিস্তান আর্মির ফেলে যাওয়া হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র,বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার,নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজগুলিতে বাংলাদেশের কোন হিস্যা মেলিনি,ভারতীয় সেনাবাহিনী সেগুলি নিজ দেশে নিয়ে যায়। বাধ্য করে বেরুবাড়ী ছেড়ে দিতে। বাধ্য করে ভারতীয় পণ্যের জন্য বাংলাদেশের বাজার উম্মুক্ত করতে। যারা নিজদেশের সেনাবাহিনীকে নিয়ে অন্যদের দেশ দখল করে তারা কি বিজিত দেশের জনগণকে সে অধিকার দেয়? একাত্তরের আওয়ামী লীগ ও তার মুক্তিবাহিনী যে নিজ শক্তিবলে পাকিস্তানী সেনাদলকে পরাস্ত করেনি –সে বিষয়টি শেখ মুজিব ও তার সঙ্গিগণের অজানা ছিল না। এখানেই শেখ মুজিব ও তার দলর বড় দুর্বলতা। এমন দুর্বলদের নেতা বানালে কি দেশের স্বাধীনতা থাকে?
ভারতীয় শোষণ ও দুর্ভিক্ষ
দুর্ভিক্ষ কোন দেশেই অকারণে আসে না। পিছনে থাকে এমন কিছু গুরুতর কারণ যা দুর্ভিক্ষকে অনিবার্য করে। বাংলাদেশে ১৯৭৩-৭৪ সালের দুর্ভিক্ষটিও অকারণে আসেনি। অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টির কারণেও আসেনি। ৯ মাসের যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশের শস্য গুদামে বা ক্ষেত-খামারে আগুণ দিয়েছিল -সেরূপ কোন কারণেও নয়। দুর্ভিক্ষের কারণঃ মুজিব সরকারের খাদ্যনীতি, প্রশাসনিক ব্যর্থতা, দলীয় নেতাকর্মীদের লুটপাট এবং সর্বোপরি ভারতের বিবেকহীন শোষণ। একাত্তরের যুদ্ধ শেষের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হাত পড়ে দেশের মওজুদ অর্থভাণ্ডার ও খাদ্যভাণ্ডারের উপর –যা পাকিস্তান সরকার রেখে যায়। ভারতও এ মওজুদ খাদ্যকে যু্দ্ধজয়ের পুরস্কার মনে করে। তাছাড়া তখন ভারত ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ খাদ্য ঘাটতির দেশ। দেশটিতে তখন কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষের বসবাস।ভারতে বাংলাদেশের চাল পাচার তখন চোরাকারবারীদের কাছে তখন লাভ জনক ব্যবসা। ফলে খোলা সীমান্ত পথে প্রচুর খাদ্যশস্য ভারতে পাচার হয়। দেশ তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে অধিকৃত। ভারতীয় সেনাবাহিনী সে পাচার রুখেনি। ফলে যুদ্ধকালীন ৯ মাসে যে খাদ্যভাব দেখা দেয়নি, তা দেখা দেয় যুদ্ধ শেষের দুই-তিন বছর পর ১৯৭৪ সালে। ফলে প্রকাশ পায় মুজিব সরকারের বিদেশ নীতির প্রচণ্ড ব্যর্থতা। দেশের বাইরে ভারত ছাড়া শেখ মুজিবের কোন বন্ধু ছিল না। জমিদারের ঘরের চাকরটি না খেয়ে বা বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেও অন্যরা খোঁজ নেয়না। অন্যরা এটিকে জমিদারের ঘরোয়া ব্যাপার মনে করে। বাংলাদেশও হয়ে দাঁড়ায় হিন্দুস্থানের ঘরোয়া ব্যাপার। শেখ মুজিবের ব্যর্থতা হলো, ভারতের আশ্রীত রাষ্ট্র ছাড়া ভিন্ন কোন পরিচয় নিয়ে বিশ্ববাসীর সামনে নিজেদের তুলে ধরতে পারেনি। বাংলাদেশের সে দূর্দিনে অন্যরা তাই পাশে দাঁড়ায়নি। ফলে দুর্ভিক্ষে বিশাল প্রাণনাশের বিষয়টি ছিল মুজিব সরকারের নিজস্ব সৃষ্টি।
সভ্যদেশে দুর্যোগে পশু মারা গেলেও তার হিসাব রাখা হয়। দেশের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণের জন্য সেটি জরুরী। কিন্তু অগণিত মানুষ মরলেও শেখ মুজিব তার হিসাব নেয়ার প্রয়োজন মনে করতেন না। তাই একাত্তরের যুদ্ধে নিহত মানুষের যেমন হিসাব করেনি, তেমনি ১৯৭৪ সালের দূর্ভিক্ষে নিহত মানুষের সংখ্যাও গণনা করিনি। মশা-মাছি ও শিয়াল-কুকুরের ন্যায় অসংখ্য মানুষ পথে ঘাটে মারা গেছে। সরকারি বিভাগের কোন কর্মচারির পদধূলি যেমন তাদের ঘরে জীবত অবস্থায় পড়েনি, তেমনি তাদের লাশের পাশেও পড়েনি। এবং এ দুর্যোগ হঠাৎ আসেনি, এসেছিল একটি সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনার অংশ রূপে। সে ভয়াভহ দুর্ভিক্ষর নেমে এসেছিল মূলত দুটি কারণে;এবং তার পিছনে ছিল দুটি সংশ্লিষ্ট পক্ষ। প্রথম কারণটি হলো, শেখ মুজিব সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও অযোগ্যতা।দ্বিতীয় কারণটি হলো,ভারতের সীমাহীন শোষণ। নিজেদের দুর্নীতি ও অযোগ্যতার পাশাপাশি ভারতীয়দের পরিচালিত শোষণ প্রক্রিয়ায় মুজিব সরকার সহযোগীর ভূমিকা পালন করে। তাই রেলের শত শত ওয়াগান বা ট্রাক ভর্তি করে বাংলাদেশের সম্পদ যখন ভারতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন আওয়ামী লীগের সরকারের কোন কর্মকর্তা ও দলটির কোন নেতা বা কর্মী কোন রূপ বাধা দেয়নি। প্রতিবাদে রাস্তায়ও নামেনি।
শুরু থেকেই ভারতের কাছে সুস্পষ্ট হয়, বাংলাদেশে ভারতীয় স্বার্থের যারা প্রকৃত বন্ধু তারা হলো শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ নয়। সেটি প্রকাশ পেয়েছে এমন কি একাত্তরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান ফিল্ড মার্শাল মানেক শ’র কথা থেকেও। তিনি বলেছিলেন,“যদি বাংলাদেশকে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়, তাহলে ভারতের আশ্চার্য হবার কিছু নেই। যেদিন আমার সৈনিকেরা বাংলাদেশকে মুক্ত করে সেদিনই আমি উপলদ্ধি করি, বাংলাদেশীদের কখনোই ভারতের প্রতি তেমন ভালবাসা ছিল না। আমি জানতাম,ভারতের প্রতি তাদের ভালবাসা অস্থায়ী। অনুপ্রেরণা লাভের জন্য ভারতের দিকে না তাকিয়ে তারা মক্কা ও পাকিস্তানের দিকে দৃষ্টিপাত করবে। আমাদের সত্যাশ্রয়ী হতে হবে। বাংলাদেশীদের সাথে আমরা সঠিক আচরণ করিনি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের সব রকমের সাহায্য করা উচিত ছিল, আমাদের রাজনীতিবিদরা তা করেননি। তারা বেনিয়ার মত আচরণ করেছেন।”-(দৈনিক স্টেট্সম্যান, কোলকাতা, ২৯ এপ্রিল ১৯৮৮)।
স্ট্রাটেজী মেরুদণ্ড ভাঙ্গার
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিজয় যে বেশী দিন থাকবে না -সে আশংকাটি দিল্লির শাসক গোষ্ঠীর শুরু থেকেই ছিল। ফলে ভারত মুজিবামলে বাংলাদেশের মেরুদণ্ড ভাঙ্গার যে মোক্ষম সুযোগটি হাতে পায় -সেটি হাতছাড়া করতে রাজী ছিল না। ভারতীয় স্ট্রাটেজিস্টদের অতি পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ কৌশলটি হলো, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিকে অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী হতে না দেয়া। সে কৌশল শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই নয়, বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও। ভারত চায় তার চারপাশে ভূটান ও নেপালের ন্যয় দুর্বল রাষ্ট্র গড়ে উঠুক। লক্ষ্যঃ প্রতিবেশী দেশগুলিকে অখণ্ড ভারতীয় মানচিত্রের মধ্যে আনা আপাততঃ সম্ভব না হলেও অন্ততঃ অভিন্ন ভারতীয় বাজার, ভারতীয় সংস্কৃতি ও ভারতীয় সামরিক বলয়ের মধ্যে আনা। প্রতিবেশী দেশের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধিকে ভারত নিজের জন্য বিপদ মনে করে। ভারত আণবিক বোমা বানানোর অধিকার রাখে, অথচ বাংলাদেশকে পুরোন আমলের মিগ বা মামূলী অস্ত্রও কিনতে দিতে রাজী নয়। বাংলাদেশকে তারা যে কতটা শক্তিশালী দেখতে চায় -এ হলো তার নমুনা। এক দিন এক কথাও বলবে, বাংলাদেশ এতো সৈন্য ও এতোগুলো ক্যান্টনমেন্টগুলো দিয়ে কি করবে? ভারতসেবী সেক্যুলারিস্টগণ তো সে কথা শুরু থেকেই বলে আসছে। প্রশ্ন হলো, প্রতিবেশী দেশ সব সময়ই বন্ধু থাকবে -সে ধারণা নিয়ে কি কোন দেশের সামরিক প্রতিরক্ষা নীতি তৈরী হয়? প্রতিদেশে যেমন সরকার বদল হয়, তেমনি নীতিরও বদল হয়। অতি বন্ধুদেশও যে কোন মুহুর্তে শত্রু দেশে পরিণত হয় -সেরূপ কাহিনী তো মানব ইতিহাসে অসংখ্য। সামরিক শক্তির বিকল্প নাই -দেশের স্বাধীনতা বাঁচতে হলে সে ইতিহাস জ্ঞানকে কি অস্বীকার করা যায়?
শুধু সামরিক শক্তির বিনাশ নয়,মজবুত অর্থনীতি নিয়ে বাংলাদেশ বেড়ে উঠুক -ভারত সেটিও চায় না। ফলে একাত্তরে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শুরু হয় পরিকল্পিত লুটপাট। কোন দেশের মেরুদণ্ড ভাঙ্গার কাজটি শুধু অস্ত্রহীন করা নয়, অর্থহীন করাও। শেখ মুজিব সেসব ভারতীয় নাশকতার বিরোধীতা করেননি; বরং সহযোগিতা করেছেন। একারণেই ভারতীয় আর্মি পাকিস্তান আর্মির ফেলে যাওয়া হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র লুন্ঠন করার সুযোগ পায়। অথচ সে অস্ত্র কেনায় অর্থ জুগিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানী জনগণও। শেখ মুজিব ও তার দলীয় নেতাকর্মীদের ভাবনাটা ছিল, সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করা তো পাকিস্তানের এজেন্ডা, বাংলাদেশের নয়। তিনি ভেবেছিলেন, পাশে ভারত থাকতে বাংলাদেশ কি করবে এতো অস্ত্র দিয়ে? শক্তিশালী সেনাবাহনীর বিরুদ্ধে মুজিবের প্রচণ্ড সন্দেহ ও ঘৃণা ছিল। ভয় ছিল, না জানি সেনাবাহিনী তাকেই ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেয়। তাই মুজিবের লক্ষ্য ছিল রক্ষিবাহিনী গড়া, শক্তিশালী সেনাবাহিনী নয়। ফলে পাকিস্তান আর্মির অব্যবহৃত অস্ত্র বাংলাদেশে রাখায় শেখ মুজিব এবং তার দলীয় নেতাদের আগ্রহ ছিল না। এজন্যই সে অস্ত্র লুটপাটে তারা বাধা দেননি। দেশের প্রতিরক্ষা নিয়ে মুজিবের কোন ভাবনা ছিল না; সেটিকে তিনি ভারতের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। তার আমলে তাই কোন কামান, ট্যাংক বা যুদ্ধ বিমান কেনা হয়নি। সেরূপ পরিকল্পনাও ছিল না।
পাকিস্তান আমলে গাজীপুরে চীনের সহয়তায় একটি অস্ত্র কারখানা গড়া হয়। ভারতীয় বাহিনীর সে অস্ত্রকারখানার অস্ত্র নির্মাণকারি যন্ত্রাপাতিও খুলে নিয়ে যায়। সে সময় আওয়ামী নেতা ও মুক্তিবাহিনীর কাজ ছিল সে লুটপাটকারী ভারতীয় সৈনিকদের ভক্তিভরে স্যালুট করা। শুধু তাই নয়, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সেনানিবাসগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও অবাঙালী পরিবারের কাছে যেসব সোনা-রুপা ও দামী জিনিসপত্র ছিল সেগুলোও লুটে ভারতে নিয়ে যায়। ভারতীয় দৈনিক সংবাদপত্র “অমৃত বাজার”-এর ১২ই মে ১৯৭৪ সাল-এর রিপোর্ট অনুসারে ভারত সরকার দুইশত থেকে আড়াইশত রেলওয়ে ওয়াগন ভর্তি অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশ থেকে ভারতে স্থানান্তরিত করে। অথচ ১৯৭৩ সালের ১১ই জুলাই বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা করেন, “ভারতে কোন অস্ত্রশস্ত্র পাচার হয় নাই বা লইয়া যায় নাই”। প্রশ্ন জাগে, যদি জনাব তাজউদ্দীন সত্য বলে থাকেন তবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ফেলে যাওয়া কয়েক শত ট্যাংক গেল কোথায়? ১৯৭৫ সালে মুজিব সরকারের অপসারণে সামরিক বাহিনীর তরুণ অফিসারগণ যে ট্যাংক ব্যবহার করেছিল সেগুলি ছিল মিশর সরকারের খয়রাতি দান। তখন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে পাকিস্তান আমলের কোন ট্যাংকই ছিল না। অতএব তাজউদ্দীন আহম্মদ যা বলেছেন সেটি সত্য ছিল না, ছিল ডাহা মিথ্যা। জাতির সাথে যারা দেশের সংসদে দাঁড়িয়ে এরূপ মিথ্যা বলেন, সে সব মিথ্যাবাদীদের থেকে জনগণ কি আশা করতে পারে? অপর দিকে ১৯৭৪ সালের ১৭ই জুন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর বলেন, ভারতে স্থানান্তরিত অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশকে ফেরত দেয়া শুরু হয়েছে। দুই মন্ত্রীর দুই ধরনের বক্তব্য। জনাব তাজউদ্দীনের মতানুসারে ভারত যদি অস্ত্র লুণ্ঠন না করে থাকে তবে তাহের উদ্দিন ঠাকুরের কথা মত ভারত সেগুলো ফেরত দেয় কি করে? আরো প্রশ্ন হলো, ভারত যদি কোন ট্যাংক ফেরত দিয়েই থাকে তবে কোথায় রাখা হলো সে ফেরতপ্রাপ্ত ট্যাংকগুলো? দুইজনের কেউই সত্য বলেননি। এই হলো আওয়ামী লীগের মিথ্যানির্ভর রাজনীতির নমুনা। মিথ্যাচর্চা শুধু শেখ মুজিবের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর আশেপাশের নেতাকর্মীদের মাঝেও।
বিধ্বস্ত হলো অর্থনীতি
একই ভাবে ভারতের হাতে পরিকল্পিত লুন্ঠনের শিকার হয় পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের শিল্প। একাত্তরের পূর্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান যে পরিমাণ বৈদিশিক মুদ্রা উপার্জন করতে তার ৯০% ভাগ আসতো কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানী করে। বাঁকিটা আসতো চা ও চামড়া রপ্তানী করে। আর এ তিনটি খাতই ছিল আন্তজার্তিক বাজারে ভারতের সাথে প্রতিযোগিতা মূলক। ভারত এ তিনটি খাতই পরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করে দেয় এবং প্রতিদ্বন্দিতার ময়দান থেকে বাংলাদেশী পণ্যকে বের করে দেয় -যা পাকিস্তান আমলে তাদের জন্য অসম্ভব ছিল। আর এর ফলে চরম আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল লক্ষ লক্ষ কৃষক পরিবার -যারা পাট থেকে তাদের উৎপাদন খরচও পাচ্ছিল না। সরকারের ভারত-তোষণ নীতির কারণে কৃষিখাত একটি অলাভজনক খাতে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিব সবসমই নিজেদের ব্যর্থতাকে অন্যদের ঘাড়ে চাপাতে অভ্যস্থ। শিল্পের এ দূর্গতির জন্যও তারা একাত্তরের যুদ্ধকে দায়ী করে। কিন্তু সেটি সঠিক ছিল না। এ ব্যাপারে ১৯৮০ সালে দৈনিক ইত্তেফাক লিখেছিল, “একাত্তরের যুদ্ধের বছর নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে তেমন কোন শিল্প প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি বা উৎপাদন ব্যাহত হয়নি। আসলে যুদ্ধটা একটা অজুহাত মাত্র। তাছাড়া জাতিসংঘের ত্রাণ কমিটির এক হিসাব থেকেও জানা যায়, বাংলাদেশের যুদ্ধজনিত সমস্ত ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে বাংলাদেশে প্রদত্ত সাহায্যের পরিমাণ ছিল তেরগুণ বেশী।”-(ইত্তেফাক সেপ্টেম্বর ৩,১৯৮০)
বরং দেশী শিল্প চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে মুজিবামলে। বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাত হলো পাট শিল্প। কিন্তু এ শিল্পকে ধ্বংস করা হয়েছে পরিকল্পিত ভাবে এবং সেটি ভারতের স্বার্থে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম পাটকল স্থাপিত হয় ১৯৫১ সালে। ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৭১ সাল এই ২০ বছরে পাটকলগুলোতে তাঁতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় শূন্য থেকে ২১,৪০০। পাকিস্তানের চতুর্থ ৫ সালা পরিকল্পনায় তাঁতের সংখ্যা বাড়িয়ে ১৯৭৫ সাল নাগাদ ৪০ হাজার করার পরিকল্পনা ছিল। তাঁতের সংখ্যা ৪০ হাজারে পৌঁছলে বিপুল ভাবে বাড়তো বৈদিশীক মুদ্রার উপার্জন। তখন বিদেশের বাজারে কাঁচা পাটের স্থলে সম্ভব হত পাটজাত পণ্যের রপ্তানি। কিন্তু পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ায় সে আশা আর পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি। অথচ বাংলাদেশে আমলে ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৮০ সালে তাঁতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫,৭০০। অর্থাৎ ৯ বছরে বেড়েছে মাত্র ৪ হাজার। তবে তাঁতের সংখ্যা কিছু বাড়লেও প্রচণ্ড ধস নামে উৎপাদনে। উৎপাদন নেমে যায় ১৯৬৯-৭০ সালেরও নিচে।
মুজিব সরকারের পাটমন্ত্রী আন্তর্জাতিক বাজারে প্রধান প্রতিদ্বন্দি ভারতের সাথে এমন এক চুক্তি করে যার ফলে বাংলাদেশের পাটশিল্পের স্বার্থ বিপন্ন হয়। অথচ পাকিস্তান আমলে পাটশিল্প ছিল দেশের সবচেয়ে লাভজনক খাত। মুজিব সরকার এটিকে লোকসানের খাতে পরিণত করে। একাত্তরের আগে পূর্ব পাকিস্তানের পাটের সরকারি ও বেসরকারি গুদামে আগুণ লেগেছে -সেটি ছিল অতি বিরল ঘটনা। কিন্তু মুজিবের শাসনামলে পাটের গুদামে আগুণ লাগার ঘটনাটি অতি ঘন ঘন ঘটতে থাকে। তখন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অতি দ্রুত বিলুপ্ত হতে থাকে বাংলাদেশী পাট, সে বাজার সহজেই দখল করে নেয় ভারত। অথচ পাকিস্তান আমলে ভারত তা ভাবতেও পারেনি। আর শেখ মুজিব সেটি তাদের ঘরে তুলে দেয়। মুজিব সরকারের আমলে ভারত সরকার কিভাবে বাংলাদেশের পাট লুন্ঠন করে তার এক বিবরণ দিয়েছেন জনাব অলি আহাদ। তিনি লিখেছেন, “স্মরণীয় যে, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরর বিজয়ী ভারতীয় বাহিনীর বাংলাদেশে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশে সীমান্ত একাকার হইয়া যায়। বিনা অনুমতিতে বা বিনা দলিলেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় জনতা ও পণ্যের স্রোত প্রবাহিত হইতে থাকে। বাংলাদেশ বাস্তবে ভারতের বাজারে পরিণত হয়। বাংলাদেশ হতে লক্ষ লক্ষ গাইট পাট অবাধে সীমান্ত পারের পাটকলগুলির চাহিদা মিটাইতে আরম্ভ করে। ভারতীয় পাটকলগুলির পূর্ণোদ্যমে দুই-তিন শিফটে কাজ চালু হইয়া যায়। এমন কি বাংলাদেশের পাট-লোপাট করিয়া ভারত নতুন করে বিদেশে কাঁচাপাট রফতানী শুরু করিয়া দেয়। স্মর্তব্য, কাঁচাপাটের অভাবে ইতিপূর্বে ভারতীয় পাটকলগুলি অতি কষ্টে এক শিফটে কাজ করিত এবং ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর পাক-ভারত বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ হইয়া যাওয়ায় ভারতকে বাধ্যতঃ সিঙ্গাপুরের মাধ্যমে প্রতি বৎসর ১০ থেকে ১৫ লক্ষ বেল পাকিস্তানী পাট চড়ামূল্যে ক্রয় করিতে হইত।…অথচ মুজিবের শাসনামলে ভারত অবাধে বাংলাদেশের পাট লুন্ঠন শুরু করিয়া চলিল। সেই পাটজাত পণ্য দ্বারাই ভারত বাংলাদেশের পাটজাত পণ্যের বাজার দখল করিল। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশী কাঁচাপাট রফতানী দ্বারা ভারত নিয়মিত ভাবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করিয়া চলিল। অথচ শেখ মুজিব টু’ শব্দটি উচ্চারণ করিলেন না। ইহা কোন স্বার্থের বিনিময়ে কিংবা কোন বিশেষ কারণে? তিনি কি জ্ঞাত ছিলেন না যে, ভারতের পাটশিল্পজাত পণ্য রফতানীপ্রসূত অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাত্র ১৫% থেকে ১৭% ; কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি কাঁচাপাট ও পাটশিল্পজাত পণ্য রফতানী আয়ের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল।” ১৯৭২ সালের ২৭শে মার্চ শেখ মুজিব সরকার ভারতের সাথে সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি নামে যে চুক্তিটি স্বাক্ষর করে তার ফলে ভারত সরকার বাংলাদেশে লুটপাটের একটি বৈধ ভিত্তি পায়। তখন ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান থেকে বৈদেশিক অর্থে আমাদানিকৃত উন্নতমানের পণ্য ভারতে পাচার করা শুরু হয়। সে স্রোতের সাথে যাওয়া শুরু করে সোনা-রূপা, তামা, পাকিস্তানী আমলের ধাতব মুদ্রা, কলকারখানার যন্ত্রপাতি, সার, আমদানিকৃত বিদেশী ঔষধ এবং বাংলাদেশী মাছ।”-(অলি আহাদ)।
মুজিবের হাতে অর্থনীতির বিনাশের যে কাজ শুরু হয়েছিল, সেটি শুধু পাটশিল্পে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ধ্বংস নেমে আসে চা এবং চামড়া শিল্পেও। শিল্পের এ দুটি খাতও ছিল বিদেশের বাজারে ভারতের সাথে প্রতিদ্বন্দিতামূলক। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের কোন ইচ্ছাই ছিল না ভারতের সাথে কোনরূপ বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় নামার, ফলে একাত্তরের পূর্বে বিদেশে বাংলাদেশের চা ও চামড়ার যে বাজার ছিল ভারত তা অতি সহজেই দখলে নিয়ে নেয়। মুজিবামলে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি ঘটে তার বিবরণ জনাব অলি আহাদ দিয়েছেন এভাবেঃ “(পাকিস্তান আমলের) এক টাকার গামছার দাম হয় সাত টাকা। পাঁচ টাকার শাড়ীর দাম হয় পঁয়ত্রিশ টাকা। তিন টাকার লুংগি পনের টাকা বা কুড়ি টাকায়, দশ আনা বা বার আনা সেরের চাউল হয় দশ টাকায়। আট আনা সেরের আটা ছয়-সাত টাকা। দুই আনা সেরের কাঁচা মরিচ চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা। তিন-চার টাকা সেরের শুকনা মরিচ আশি-নব্বই টাকা। আট আনা সেরের লবণ চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা। পাঁচ টাকা সেরের সরিষার তৈল তিরিশ-চল্লিশ টাকা। সাত টাকা সেরের নারীকেল তৈল চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা। সাত টাকার লাঙ্গল ত্রিশ-চল্লিশ টাকা।”
জালনোট ও অর্থনীতিতে নাশকতা
বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংসে ভারত আরেকটি বৃহৎ প্রকল্প হাতে নেয়। সেটি হলো, বাংলাদেশের ক্যারেন্সির কোটি কোটি জাল নোট ছেপে বাজারে ছাড়া। আর সে ভারতীয় প্রকল্পটির বাস্তবায়নে মহা সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় শেখ মুজিব নিজে। তিনি বাংলাদেশের জন্য নতুন ক্যারেন্সি নোট ছাপানো দায়িত্ব কোন নিরপেক্ষ দেশকে না দিয়ে ভারতের ন্যায় এমন একটি দেশের হাতে তুলে দেন যার ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিশাল অর্থনৈতিক ও স্ট্রাটেজিক স্বার্থ। মুজিব ভারতকে যে পরিমাণ নোট ছাপতে বলেছিল তার চেয়ে বহু শত কোটি টাকার বেশী নোট ছেপে বাংলাদেশী টাকার চরম অবমূল্যায়ন ঘটায়। একাত্তরে পাকিস্তানী মুদ্রার বাজার দর ভারতীয় মুদ্রার চেয়ে অনেক বেশী ছিল, কিন্তু মুজিব আমলে বাংলাদেশী মুদ্রার বিনিময় হার ভারতীয় মুদ্রার অর্ধেকেরও কমে এসে দাঁড়ায়। বাজারে জাল নোট থাকা কোন দেশের জন্যই ভাল নয়। কোন দেশে শত শত কোটি টাকার জাল নোট থাকলে তার অর্থনৈতিক নাশকতাটি ভয়ানক।
ভারত যে অতিরিক্ত নোট ছেপে বাংলাদেশের অর্থনীতির সর্বনাশ করছে সেটি অন্যরা বুঝলেও শেখ মুজিব বুঝেছিলেন অনেক দেরীতে। হয়ত জেনে শুনেও বুঝতেই চাননি। যখন বুঝলেন, তখনও সে জাল মুদ্রাকে সাথে সাথে অচল ঘোষণা না করে দুই মাস সময় দেন। ফলে ভারতীয়রা বাড়তি সময় পায় আরো বেশী বেশী নোট ছেপে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রায় অর্জিত সোনা-রোপা ও বিদেশী যন্ত্রাংশ কিনে ভারতে পাচারের। কোন কিছু জাল নোটে কেনার অর্থই হলো, কোনরূপ মূল্য না দিয়ে কেনা। এটি বিনা মেহনতে ডাকাতি। আর এটিই ছিল বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের অতি সুস্পষ্ট দুর্বৃত্তি। কিন্তু আওয়ামী বাকশালী চক্রটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কৃত ভারতেরএ মহাঅপরাধের বিষয়টি তাদের রচিত ইতিহাসের পাতা থেকেই গায়েব করেছে। অথচ ভারতের এ অপরাধের কারণেই বাংলাদেশে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ এবং তাতে মৃত্যু ঘটে লক্ষ লক্ষ মানুষের। এবং আন্তর্জাতিক মহলে বাড়ে প্রচণ্ড অপমান বাড়ে বাংলাদেশের। ২৩ বছরের পাকিস্তান আমলে সেটি ঘটেনি। এতোবড় খাদ্যাভাব, এতো মৃত্যু ও বিশ্বজোড়া এতো অপমান ৯ মাস যুদ্ধকালীন সময়েও ঘটেনি।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018