অধ্যায় চৌদ্দ: ভাষার নামে নাশকতা
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on December 29, 2018
- ই-বুকস
- No Comments.
ভাঙ্গার কাজের শুরু
মুসলিম ইতিহাসে বড় বড় ক্ষতিগুলো ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় বা সুনামীতে হয়নি। কলেরা,যক্ষা বা টাইফয়েডের ন্যায় রোগের মহামারিতেও হয়নি। হয়েছে বর্ণ, গোত্র, ভূগোল, ভাষা ও ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তার নামে। উসমানিয়া খেলাফত ভেঙ্গে ২৫টির বেশী রাষ্ট্র গড়া হয়েছে বিভিন্ন ভাষা ও গোত্রের নামে। যে কোন দেশের ন্যায় মুসলিম দেশেও বিস্তর সমস্যা ছিল। কিন্তু সমাধান খোঁজা হয়েছে বিভক্তির মাঝে। কিন্তু বিভক্তিতে যে পবিত্র কোরআনে ঘোষিত মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিশ্রুত আযাব ডেকে আনে -সে হুশ মুসলমানদের ছিল না। বিভক্তির কারণে মুসলিমদের উপর প্রতিশ্রুত আযাবের ঘোষণাটি এসেছে সুরা আল-ইমরানের ১০৫ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে, “এবং তোমরা তাদের মত হয়োনা যারা সুস্পষ্ট নির্দেশনা (কোরআন) আসার পরও পরস্পরে মতভেদ করলো এবং বিভক্ত হলো; তাদের জন্য রয়েছে কঠোর আযাব। তাই মুসলিম দেশ বিভক্ত হলো অথচ তাদের উপর মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে তাঁর প্রতিশ্রুত আযাবটি এলো না -সেটি অভাবনীয়। আজকের মুসলিম বিশ্ব তো সে আযাবপ্রাপ্তিরই নজির। মুসলিম দেশের বিভক্তিতে সমস্যার সমাধান না হয়ে বরং বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়েছে শক্তিহীনতা, বেড়েছে শত্রুর হাতে মৃত্যু, ধ্বংস, ধর্ষণের ন্যায় নানারূপ বিপর্যয়। বেড়েছে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির উপর শত্রুশক্তির দখলদারি। শরিয়তের প্রতিষ্ঠা এবং মুসলিম উম্মাহর বুক থেকে বিভক্তির দেয়াল নির্মূলের অঙ্গীকার নিয়ে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় নামলেই শত্রুপক্ষের বোমা বর্ষণ শুরু হয়। মুসলিম ভূমিতে আসন গেড়ে বসেছে ইসরাইল। বিভক্তির কারণেই ৫৫টির বেশী মুসলিম দেশের প্রায় দেড়শত কোটি মুসলিম আজ শক্তিহীন। জাতিসংঘের ন্যায় আন্তর্জাতিক ফোরামে সাড়ে ৫ কোটি ব্রিটিশ বা ৬ কোটি ফ্রান্সবাসীর যে প্রভাব ও প্রতিপত্তি, ১৫০ কোটি মুসলিমের তা নাই।
বিভিন্নি ভাষাভাষীদের নিয়ে গড়া পাকিস্তানের অস্তিত্বের বিরুদ্ধেও সবচেয়ে কঠোর আঘাতটিও হানা হয় ভাষার নামে। বস্তুত ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন থেকেই শুরু হয় পাকিস্তান ভাঙ্গার আন্দোলন। এ আন্দোলনে পশ্চিম পাকিস্তানীদেরকে বাঙালীর শত্রু রূপে চিহ্নিত করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগটি বাঙালীর মুখের ভাষা কেড়ে নেয়ার। উর্দু ভাষা চিহ্নিত হয় বাঙালীর শত্রুর ভাষা রুপে। এতে বাড়তে থাকে বাঙালী-অবাঙালীর মাঝে মনের দুরত্ব এবং পাকিস্তানের রাজনীতিতে ধরে গভীর ফাটল। ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য নিছক বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেয়া ছিল না, বরং সেটি ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গার লক্ষ্যে ইস্যুটিকে কাজে লাগানো। সেটি পরে প্রমাণিতও হয়। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেয়া হলেও তাই পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্রে ভাটা পড়েনি। এ আন্দোলনের সাথে অতি সক্রিয় হয়ে পড়ে সেসব বুদ্ধিজীবী ও নেতৃবৃন্দ -যারা ১৯৪৭য়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রচণ্ড বিরোধীতা করেছিল এবং নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিল।
আন্দোলনটি শুরু করে তমুদ্দন মজলিশ নামে একটি সংগঠন যারা ইসলামী তাহজিব ও তমুদ্দনের কথা বলে। তারা ইসলামী শাসন ও চেতনার কথাও বলে। কথা হলো, আন্দোলনের জন্য দিনক্ষণটি কি যথার্থ ছিল? ভারতে তখনও রাষ্ট্র ভাষার ইস্যু নিয়ে কোন সমাধান হয়নি। কোন বিতর্কও শুরু হয়নি। অথচ সে বিতর্ক শুরু হলো পাকিস্তানে। শয়তান সব সময়ই মুসলিমদের পিছনে লাগে, কাফেরদের পিছনে নয় –এ হলো তার প্রমাণ। পাকিস্তান তখন তার ক্ষতবিক্ষত পোকায় খাওয়াদেহ নিয়ে সবে মাত্র যাত্রা শুরু করেছে।তখনও দেশটি তার নিজের ঘর গুছিয়ে নিতে পারেনি। ভারত থেকে পালিয়ে আসা লক্ষ লক্ষ মোহাজির পুনর্বাসন নিয়ে দেশটি তখন হিমসিম খাচেছ। সমাধান হয়নি দেশের শাসনতান্ত্রিক সমস্যার। দেশ পরিচালনার জন্য যে প্রশাসনিক অবকাঠামো দরকার,তখনও সেটি গড়ে উঠেনি। ওদিকে মরণ কামড় দিতে ওঁত পেতে বসে ছিল প্রতিবেশী শত্রু রাষ্ট্রটি। তারা তো চাচ্ছিল, কোন একটি ইস্যু নিয়ে দেশের দুটি অঙ্গের মাঝে বিভেদ গড়ে উঠুক। আর তখনই শুরু হলো ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের শুরু তমুদ্দন মজলিসের দ্বারা হলেও সে আন্দোলনের নেতৃত্ব অচিরেই পাকিস্তানের শত্রুদের হাতে চলে যায়।
রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি যে কোন দেশেই গুরুতর বিষয়। বিশ্বের বহু দেশে এর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বছরের পর বছর ধরে চিন্তাভাবনা হয়। সমঝোতারও চেষ্টা হয়। রাজপথ উত্তপ্ত না করে এক উত্তেজনামুক্ত পরিবেশে দেশের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা এ নিয়ে গভীর চিন্তা ভাবনা করেন, দেশের সবচেয়ে বিদগ্ধ ব্যক্তিগণ এ নিয়ে সেমিনারের পর সেমিনার করেন। এভাবে নিজেদের মাঝে মতের আদান প্রদানও করেন। অথচ তমুদ্দন মজলিশ ও তার সেক্যুলার মিত্ররা এ নিয়ে সময় দিতে রাজী হয়নি। আলাপ-আলোচনা ও চিন্তাভাবনার চেয়ে রাজপথে গোলযোগ সৃষ্টির পথটি তারা বেছে নেয়। গুরুত্ব পায় লাশের রাজনীতি। সে সুযোগটি তারাও পেয়ে যায়তৎকালীন সরকারের ভুল পলিসির কারণে। অথচ সংসদে বা আলাপ-আলোচনার টেবিলে সহজেই এ সমস্যার সমাধান বের করা যেত। শত্রুশক্তির সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যদি পাকিস্তান অর্জিত হতে পারে,তবে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি কেন নিজেদের মাঝে আলাপ-আলোচনায় সমাধান করা যাবে না?
ভাষা আন্দোলনের নাশকতা
ভাষা আন্দোলন যে ভাবে পাকিস্তানে আত্মঘাতি রূপ নেয়, ভারতে তেমনটি ঘটেনি। অথচ সে সমস্যাটি আরো জটিল ছিল ভারতে। কিন্তু সেটি নিয়ে ভারতে সমস্যাটি দানা বাঁধে অনেক দেরীতে। দক্ষিণের তামিলগণ হিন্দিকে রাষ্ট্র ভাষা রূপে মেনে নিতে রাজী ছিল না। তুমুল দাঙ্গা শুরু হয় মাদ্রাজসহ দক্ষিণ ভারতের বহু নগরে। কিন্তু ভাষার প্রশ্নটি যখন তুমুল আকার ধারণ করে, তখন ভারত তার মেরুদণ্ডকে শক্ত করে নিয়েছে। সেটির একটি সমাধানও বের করে। ভাষা নিয়ে রাজনৈতিক খেলা শুরুর সাথে সাথে সেখানকার নেতারা ভাষা আন্দোলনের নামে স্বাধীনতা-পরবর্তী দুর্বল সরকারকে লাল কার্ড দেখায়নি। দিল্লির সরকার এ সমস্যার সমাধানে দীর্ঘ সময় পেয়েছিল। হিন্দিভাষীদের বিরুদ্ধে অন্যদের মুখের ভাষা কেড়ে নেয়ার অভিযোগও তুলেনি। দেশ জুড়ে হরতাল ও ধর্মঘটের ন্যায় অরাজকতাও সৃষ্টি করেনি -যেটি পূর্ব পাকিস্তানে হয়েছে। অবশেষে সারা ভারতের জনগণ হিন্দিকে রাষ্ট্র ভাষা রূপে মেনে নেয়। মেনে নিয়েছে পশ্চিম বাংলার বাঙালীরাও। মেনে নিয়েছে দক্ষিণ ভারতের লোকেরা। অথচ এ ভাষার সাথে দক্ষিণ ভারতের লোকদের সম্পর্ক নাই। প্রথমে তারা হিন্দি ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা রূপে মেনে নেয়ার বিরোধীতা করলেও অবশেষে এ নিয়ে কোন লংকা কাণ্ড বাধায়নি,যা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঘটেছে। পাকিস্তানের চেয়ে বহুগুণ বৃহৎ হলো ভারত, কিন্তু রাষ্ট্র ভাষা হলো একমাত্র হিন্দি। কিন্তু পাকিস্তানে রাষ্ট্র ভাষা হলো দুটি। ভারতীয় ছাত্র-জনতা-বুদ্ধিজীবীগণ যেপ্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে তা পাকিস্তানের কপালে জোটেনি। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে এটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। নইলে ভাষার সমস্যা নিয়ে পাকিস্তান যেমন ভেঙ্গে গেল,ভারতের কপালেও সেটি হতে পারতো।
অনুরূপ প্রজ্ঞার বলে উত্তর আমেরিকায় জন্ম নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র -যা আজ বিশ্বের প্রধানতম বিশ্বশক্তি। যুক্তরাষ্ট্রে বহু গর্বিত জনগোষ্ঠীর বসবাস। ইংরেজদের পাশাপাশি জার্মান, ফ্রেঞ্চ, ডাচ, স্পেনীশসহ নানা ভাষাভাষির মানুষ ইংরেজীকে রাষ্ট্র ভাষা রূপে গ্রহণ করেছে। অথচ অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ভাষারও রাষ্ট্র ভাষা হওয়ার যোগ্যতা ছিল। এতে তাদের ভাষাগুলি যে মারা গেছে তা নয়। বর্তমান পাকিস্তানের শতকরা প্রায় ষাট ভাগ মানুষের ভাষা পাঞ্জাবী। অথচ বাঙালীরা ছিল ৫৬%। কিন্তু তারা সংখ্যার জোরে পাঞ্জাবীকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবী তোলেনি। পাঞ্জাবী দ্বিতীয় রাষ্ট্র ভাষা হোক -সে দাবীও তারা তোলেনি। তারা বৃহত্তর পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার মধ্যেই পাঞ্জাবের কল্যাণ দেখেছে, ভাষার বিরোধ নিয়ে পাকিস্তানকে ক্ষুদ্রতর করায় মধ্যে নয়–যেমনটি বাঙালীরা ভেবেছিল। পাঞ্জাবীদের সে নীতির কারণেই পশ্চিম পাকিস্তান যে শুধু ভাঙ্গন থেকে বেঁচে গেছে তা নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্বের ৫৭টি রাষ্ট্রের মাঝে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র রূপে আজও বেঁচে আছে। একমাত্র পাকিস্তানের হাতেই রয়েছে আনবিক বোমা ও মুসলিম বিশ্বের সর্ববৃহৎ সেনাবাহিনী। ১৬ কোটি বাংলাদেশী ১৮কোটি পাকিস্তানীর সাথে সে মিশনে শামিল হলে কি বাঙালী মুসলমানের গৌরব কমে যেত?
বাঙালীদের মনে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার গর্বটি এতোটাই প্রবল ছিল যে সে আমলে অনেক বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ উর্দুর বদলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীর ভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করারও দাবী তুলেছিল। এবং ভাষার সে গর্ব নিয়েই অবশেষে তারা পাকিস্তানকেই ভেঙ্গে ফেললো। ভাষার ইতিহাসে অতি প্রাচীনতম ঐতিহ্যের দেশ হলো মিশর। নিজ মাতৃভাষা কবরস্থ করে আরবী ভাষাকে গ্রহণ করায় তারা বরং প্রচণ্ড লাভবানই হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান পবিত্র কোরআন থেকে তারা যেমন লাভবান হয়েছে, তেমনি নেতা রূপে আবির্ভূত হতে পেরেছে আরব বিশ্বের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণে। ভাষার গর্ব নিয়ে মুসলিম উম্মাহর বুকে জাতীয়তাবাদের ফেতনাটি সর্ব প্রথম শুরু করে ইরান; তারাই মুসলিম বিশ্বে সর্বপ্রথম বিচ্ছিন্নতাবাদী। কিন্তু সে বিচ্ছিন্নতা তাদের কল্যাণ দেয়নি; বরং তাদের বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ থেকে। ফলে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্রই তারা পরিত্যক্ত।
ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক, এ আন্দোলনে প্রচুর মিথ্যাচার হয়েছে। ভাষার নামের দেশ জুড়ে গভীর ঘৃণা ও বিষ ছিটানো হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানীদের মাঝে রটিয়ে দেয়া হলো, পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙালীর মুখের ভাষাকে কেড়ে নিতে চায়।অতএব তারা বাঙালীর শত্রু। বাঙালী-অবাঙালীর ঐক্য বিনাশে এটি ছিল এক বিশাল নাশকতা। ইসলামের শত্রুপক্ষ তো সেটিই চাচ্ছিল। অথচ বিচারে আনা হলো না, উর্দু ভাষা রাষ্ট্র ভাষা হওয়াতে পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান ও বেলুচীদের মুখের ভাষাকে কি তাদের মুখ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে? তাদের কি বোবা বানানো হয়েছে? ভারতের রাষ্ট্র ভাষা হিন্দি হওয়াতে কি বাংলা ভাষা আবর্জনার স্তূপে পড়েছে? অথচ এ কথা বলা হলো না, যে পশ্চিম পাকিস্তানের উপর এ অভিযোগ চাপানো হচ্ছে তাদের মাতৃভাষা উর্দু নয়। এরূপ নিরেট মিথ্যাকে ভিত্তি করে বাংলায় কত গান, কত কবিতা, কত ছড়া, কত গল্প ও নাটক লেখা হলো। তৈরী হলো কত সিনেমা। এতো বিষ, এতো ঘৃণা ও এতো মিথ্যাচার দেহে নিয়ে একটি জাতি কি সুস্থ্ থাকতে পারে? এর পরিণাম কি ভুল বুঝাবুঝি ও বিভেদ নয়? এরূপ ঘৃণা ও বিদ্বেষের জোয়ারে ভেসে যায় বাঙালী-অবাঙালী মুসলিমদের মাঝে পারস্পরিক ভ্রাতৃসুলভ শ্রদ্ধাবোধ ও ভালবাসা। দেয়ালের সিমেন্ট খসে পড়লে দেয়াল ভাঙ্গতে মেহনতের প্রয়োজন পড়ে না। জনগণের মাঝে তেমনি পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ বিলুপ্ত হলে সে দেশ ভাঙ্গতে কি বেগ পেতে হয়? একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে ভাষা আন্দোলন তো সে কাজটিই করেছে।
ভাষার দায়ভার
একটি দেশের বু্দ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাদের মূল দায়িত্ব, দেশবাসীর মাঝে সিমেন্ট লাগানো; সিমেন্ট খোলা নয়। সিমেন্ট লাগানোর কাজটি হয় যেমন রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের মাধ্যমে, তেমনি রাষ্ট্র ভাষার মাধ্যমে। সে সিমেন্টটি ধর্মীয় বিশ্বাস, রাজনৈতিক দর্শন ও জ্ঞানের। এতে একতা, সংহতি ও সামাজিক সম্প্রীতি বাড়ে। যে কোন দেশে এটিই হলো গুরুত্বপূর্ণ সোসাল ক্যাপিটাল তথা সামাজিক পুঁজি। সমাজ উন্নয়নে আর্থিক পুঁজির চেয়ে এ সামাজিক পুঁজির গুরুত্বটি আরো অধিক। এ পুঁজির বলেই দেশ দ্রুত সামনে এগুয় এবং জনগণের জীবনে শান্তি আসে। একতা সৃষ্টির এমন কাজটি ইসলামে পবিত্র ইবাদত; এবং বিভেদ সৃষ্টির যে কোন কাজই হারাম। অথচ ভাষা আন্দোলনের নামে বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল জনজীবন থেকে সিমেন্ট সরানোর কাজে। ভাষার কাজ শুধু এ নয় যে, সে ভাষায় কেবল কথা বলা হবে। সাইনবোর্ড, রায় বা দলিল লেখা হবে। বরং প্রতিটি ভাষাকে এর চেয়ে আরো অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। নইলে সে ভাষার লোকদের ব্যর্থতার সীমা থাকে না। তখন সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি আসে মানুষ রূপে বেড়ে উঠায়।
ভাষার মূল কাজটি হলো জনগণের মনে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পুষ্টি জোগানো। সভ্যতর ভাবে বাঁচবার লক্ষ্যে উচ্চতর দর্শন জোগানো। নানা জাতির মাঝে মন ও মনন, চরিত্র এবং সংস্কৃতিতে যে বিশাল তারতম্য -তা তো সৃষ্টি হয় জ্ঞানভাণ্ডার ও জীবন দর্শনে তারতম্যের কারণে।খাদ্য-পানীয়, ভূমি বা জলবায়ুর কারণে নয়। মহান নবীজী (সাঃ) আরবের মানুষের খাদ্যতালিকা ও পোষাক-পরিচ্ছদে পরিবর্তন আনেননি। তাঁর আগমনে আরবের আবহাওয়া বা জলবায়ু্ও পাল্টে যায়নি। তিনি পরিবর্তন এনেছিলেন তাদের জীবন দর্শনে তথা বাঁচবার ফিলোসফিতে। তাদের কাছে পৌছে দিয়েছিলেন কোরআনী জ্ঞানের মহা জ্ঞানভাণ্ডার। সেটি আরবী ভাষায় নাযিলকৃত পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে। এতেই আরবদের ইতিহাস পাল্টে গেল। সে মরুভূমিতে জন্ম নিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। বাংলা ভাষায় বাঙালী কথা বলে ঠিকই, কিন্তু বাঙালীর মন ও মনন কি সেরূপ কোন পুষ্টি পেয়েছে? ভাতে,মাছে ও ফলমূলে দৈহিক ভাবে বাঁচাটি নিশ্চিত হলেও সে বাঁচার মধ্য দিয়ে সভ্যতা নির্মিত হয় না। উচ্চতর সংস্কৃতিও গড়ে উঠেনা। আন্দামান-নিকোবার ও পাপুয়া নিউগিনির আদিবাসীদের অনেকেই দৈহিক বলে ইউরোপীয়দের চেয়েও শক্তিশালী। কারণ, সে দেশের বনে জঙ্গলে ফলমূল ও শিকারযোগ্য জন্তুর এখনও অভাব পড়েনি। কিন্তু মনের পুষ্টিতে তাদের দৈন্যদশা এতোটাই প্রবল যে, তারা এখনও রয়ে গেছে প্রাচীন প্রস্তর যুগে। পশুদের ন্যায় সে বন্য নারী-পুরুষের দেহেও কোন বস্ত্র থাকে না। বনের মাঝে তাদের কোন ঘরও নাই। বনেজঙ্গলে জন্তু-জানোয়ারের মতই গাছের নীচে, ঝোপের মাঝে বা মাটির গুহায় তারা ঘুমায় ও জীবন কাটায়। ঘরবাড়ি বানাতে তারা শেখেনি,বস্ত্র তৈরী ও খাদ্য পাকানোর সামান্যতম জ্ঞানও তাদের নাই। তারা বেড়ে উঠেছে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে। বিগত হাজার হাজার বছরেও তাদের চিন্তা-চেতনা ও জ্ঞানের ভাণ্ডারে কোনরূপ পরিবর্তন আসেনি।
একটি জাতির দৈহিক স্বাস্থ্যের মানটি বুঝা যায় খাদ্য তালিকা দেখে। তেমনি চেতনা ও সভ্যতার মানটি বুঝা যায় সেদেশের বই-পুস্তকের মান দেখে। এ নিয়ে কোন সুষ্ঠ বিচারে বিশাল গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না। পাঠ্য তালিকায় মহাজ্ঞানী আল্লাহর গ্রন্থ আল-কোরআন স্থান পেলে মানুষের মন ও মনন যে মান নিয়ে বেড়ে উঠে তাই কি পুথিঁ-পাঠ, কবিতা পাঠ, উপন্যাস পাঠ, রবীন্দ্র-সংগীত বা আউল-বাউলের গানে সম্ভব? ইসলামের আগমনে বিপ্লব এসেছিল আরবদের পাঠ্য তালিকায়। “হে বিধাতা,সাত কোটি প্রাণীরে রেখেছো বাঙালী করে, মানুষ করনি।” কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালীর ব্যর্থতা নিয়ে তাঁর রচিত কবিতার এ ছত্রটি প্রচণ্ড দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সেটি বাঙালীর শারীরীক ভাবে বেড়ে উঠার ব্যর্থতা নিয়ে নয়। সে আফসোসটি মন ও মননে বেড়ে না উঠার কারণে। রবীন্দ্রনাথ বাঙালীর বেড়ে উঠার এ দারুন ব্যর্থতা নিয়ে কবিতা লেখেছেন। কিন্তু ব্যর্থতার কারণটি চিহ্নিত করেননি। তার মত একজন হিন্দুর পক্ষে সেটি জানা সম্ভবও ছিল না। সেটি না জানার কারণে বেড়ে উঠার প্রচণ্ড ব্যর্থতা ছিল খোদ রবীন্দ্রনাথেরও। চেতনার সে বিশাল ব্যর্থ নিয়েই কলকাতার রাস্তায় ঢাকা শহরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা রুখতে তিনি মিছিলে নেমেছিলেন। কিন্তু সে কারণটি বুঝতে মিশরীয়দের দেরী হয়নি। ইসলাম কবুলের সাথে সাথেই তারা সেটি বুঝেছিল। সেটি বুঝে যে কোন ঈমানদার ব্যক্তিই। পরিপূর্ণ ঈমানদার রূপে বেড়ে হওয়ার গরজেই মিশরীয়রা তাদের পাঠ্য তালিকা থেকে তাদের নিজ দেশের প্রাচীন মিশরীয় সাহিত্য ও ভাষা বাদ দিয়ে পবিত্র কোরআন ও তার ভাষাকে গ্রহণ করেছিল। মিশরীয়দের সমগ্র ইতিহাসে এটিই ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তটি খুলে দেয় সিরাতুল মোস্তাকীম তথা জান্নাতপ্রাপ্তির দরজা। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ স্রেফ ব্যবসায়ীক, পেশাগত বা রাজনৈতিক কারণে ভাষা পাল্টায়। পাশ্চাত্যে বসবাসকারি বাঙালীগণ সেটিই করছে। কিন্তু মিশরীয়গণ তাদের মাতৃভাষা পরিত্যাগ করেছিল অনন্ত অসীম আখেরাত বাঁচাতে। আরবী ভাষাকে তারা গ্রহণ করেছিল মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত থেকে ফায়দা হাসিলের স্বার্থে। এজন্য তাদেরকে কেউ বাধ্যও করেনি। যে খাদ্য পুষ্টি জোগায় না সে খাদ্য গ্রহনে শ্রমদান ও অর্থদানে লাভ আছে কি? বিষয়টি তেমনি ভাষার ক্ষেত্রেও। মিশরবাসীগণ সে প্রজ্ঞারই পরিচয় দিয়েছিল আরবী ভাষাকে গ্রহণ করে।অথচ তারা পিরামিড নির্মাণ, কাগজ আবিষ্কার, উন্নত চাষাবাদ, তূলাচাষ, উন্নত বস্ত্র নির্মাণ, বর্ণ ও লিখনরীতি আবিষ্কারে বিশ্বের সমগ্র জাতি থেকে তারা বহু হাজার বছর এগিয়ে ছিল। এজন্যই মিশরকে মানব সভ্যতার সূতিকাঘর বলা হয়। শুধু মিশরবাসী নয়, একই পথ ধরেছিল সিরিয়া, ইরাক, আলজিরিয়া, মরোক্কা, তিউনিসিয়া, মৌরতানিয়া, মালি, লিবিয়া ও সূদানের মুসলিমগণ। তাতে তাদেরও প্রচণ্ড লাভ হয়েছিল। সভ্যতর হওয়ার এ কোরআনী পথ ধরার কারণেই মানব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা –ইসলামী সভ্যতা নির্মাণে তারা নিজ নিজ অবদান রাখতে পেরেছিলেন।
বাঙালী মুসলিমের সাহিত্যসংকট
বাঙালী মুসলিমের প্রধান সংকটটি রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক নয়। সবচেয়ে বড় সংকটটি হলো সাহিত্যের। বাঙালী মুসলিমের অন্যান্য সংকটগুলির জন্ম মূলত সে সাহিত্যিক সংকট থেকেই। সাহিত্যের অর্থ কিছু কবিতা ও গান, কিছু গল্প বা উপন্যাস নয়। কিছু কবি,লেখক বা বিজ্ঞানীর নোবেল প্রাইজ পাওয়াতে সাহিত্যের এ সংকটটি দূর হয় না। সাহিত্যের গুরুত্ব আরো ব্যাপক। দৈহিক সুস্বাস্থের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য ও পানীয়ের তালাশ করতে হয়। বাঁচতে হয় দুষিত ও বিষাক্ত খাবার থেকে। তেমনি উন্নত দর্শন, সুস্থ চেতনা ও নৈতিক সুস্বাস্থ্যের জন্য শ্রেষ্ঠ জ্ঞান ও শ্রেষ্ঠ দর্শনের তালাশ করতে হয়। বাঁচতে হয় কুসাহিত্যে ও কুদর্শন থেকে। এখানেই ভাষার গুরুত্ব। ঈমান নিয়ে বেড়ে উঠার তাড়নাই মুসলিম জীবনের মূল তাড়না। পানি ছাড়া যেমন কোন প্রাণী বা উদ্ভিদ বাঁচে না, তেমনি বিশুদ্ধ জ্ঞান ছাড়া কোন ব্যক্তির ঈমানও বাঁচে না। তখন অসম্ভব হয় মানব রূপে বেড়ে উঠা। দেহের খাদ্য কীট-পতঙ্গো ও পশুও জোগার করতে পারে। কিন্তু আত্মার খাদ্য জোগারের কাজটি একমাত্র মানুষের।এবং সে খাদ্যটি ক্ষেতে বা বনেজঙ্গলে মেলে না। সেটির একমাত্র উৎস হলো ওহীর জ্ঞান। মহান আল্লাহতায়ালা তাই কৃষিজ্ঞান, চিকিৎসাজ্ঞান বা বিজ্ঞানের জ্ঞান বাড়াতে কোন কিতাব নাযিল করেননি; কোন নবী বা রাসূলও পাঠাননি। বরং লক্ষাধীক নবী-রাসূল ও ৪ খানি আসমানী কিতাব পাঠিয়েছেন মানব জাতির আত্মায় সত্য-জ্ঞানের সে প্রয়োজনটি মেটাতে। তাই কোন ব্যক্তির শ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞা শুধু দেহের পুষ্টিকর খাদ্যের সন্ধান লাভ নয়, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রজ্ঞা বা লাইফ স্কীল হলো মহান আল্লাহতায়ার নাযিলকৃত সে ওহীর জ্ঞানের সন্ধান লাভ। নইলে মানুষ রূপে বাঁচাটিই শুধু ব্যর্থ হয় না, সে ব্যর্থতার ফলে অনন্ত অসীম কালের জন্য জাহান্নামের আগুণে গিয়ে পৌছাও অনিবার্য হয়ে উঠে। বস্তুত সে গভীর প্রজ্ঞার বলেই মিশরীয়, সিরিয়ান,ইরাকী, আলজিরিয়ান, মরোক্কান, লিবিয়ান ও সূদানী মুসলিমগণ ইসলাম কবুলের সাথে সাথেই আরবী ভাষাকে নিজেদর ভাষা রূপে গ্রহণ করেছিল। একই কারণে পাকিস্তানের পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধি ও বেলুচীরা নিজেদের মাতৃভাষার বদলে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা রূপে গ্রহণ করেছে। কারণ, চেতনায় পুষ্টি জোগানোর ক্ষেত্রে তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষার তূলনায় উর্দু ভাষার সামর্থটি বিশাল। সে সামর্থ্যটি বাড়াতেই উর্দু ভাষা গড়ে উঠেছিল বহু শত বছর ধরে সমগ্র উপমহাদেশের মুসলিমদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। এ ভাষাটির উন্নয়নে বিনিয়োগ ছিল ভারতের বিভিন্ন এলাকার মুসলিম শাসকদেরও। উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম চেতনায় জ্ঞানের পুষ্টি জোগানো। উর্দু বিহারীদের দান নয়, পাঞ্জাবীদেরও নয়। এ ভাষাটির উন্নয়নে অন্যদের পাশাপাশি এমনকি হাজার হাজার বাঙালী আলেম ও বুদ্ধিজীবী শত শত বছর ধরে কাজ করেছে। বাংলাদেশের সকল মাদ্রাসাতে উর্দু ভাষাতেই শিক্ষা দেয়া হত। অনেক উর্দু বইয়ের লেখকও তারা। উর্দু ব্যবহৃত হত উপমহাদেশের অন্যান্য প্রদেশেও। ফার্সীর পর উর্দুই স্বীকৃতি পায় উপমহাদেশের মুসলমানদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির ভাষা রূপে। কারণ ইসলামী জ্ঞানের দিক দিয়ে আরবী ভাষার পরেই হলো উর্দুর স্থান। বাংলা, পাঞ্জাবী, সিন্ধি, গুজরাতি বা অন্য কোন ভাষায় সে কাজটি হয়নি। সেক্যুলার বাঙালীদের কাছে এ বিষয়টি আদৌ গুরুত্ব পায় নি। তবে গুরুত্ব না পাওয়ার বোধগম্য কারণও রয়েছে। কারণ,তাদের এজেন্ডা তো মুসলিমদের ইসলাম থেকে দূরে সরানো। কারণ, ইসলামের প্রতিষ্ঠায় মুসলিমদের অঙ্গীকারহীন করাই তো তাদের রাজনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতি। ফলে আরবী বা উর্দুর ন্যায় যে ভাষা মুসলিম চেতনায় কোরআনী জ্ঞানের পুষ্টি জোগায় সে ভাষার প্রতি তাদের আগ্রহ থাকার কথা নয়। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তো তারা সেটিই প্রমাণ করেছে।
পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাকালে বাংলা ভাষার দৈন্যতাটি ছিল বিশাল। বাংলা ভাষায় তখন কোন তফসির গ্রন্থ ছিল না। অনুদিত হয়নি কোন হাদীস গ্রন্থ। রচিত হয়নি নবীজী(সাঃ)র কোন জীবনী-গ্রন্থ। বাংলা ভাষার মাধ্যমে ইসলামের মহান বীরদের জানার কোন উপায় ছিল না। বাংলা সাহিত্যের শুরু হয় চর্যাপদ, বৈষ্ণব পদাবলী, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, মনসা মঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, নাথ সাহিত্য, শ্রী চৈতন্যের কীর্তন, রাময়ন ও মহাভারতের অনুবাদের মধ্য দিয়ে। এসব সাহিত্যের নাড়ির টানটি মূলতঃ পৌত্তলিকতার সাথে। সপ্তদশ শতাব্দীতে ও তার পরে আলাওল, শাহ মুহাম্মদ সগীর, সৈয়দ সুলতান ও অন্যান্য মুসলমান সাহিত্যিকের হাতে কবিতা ও পুঁথি সাহিত্য রচিত হলেও সে সীমিত সাহিত্য ভাণ্ডার কি বিশাল বাঙালী মুসলিম জনগণের জন্য যথেষ্ঠ? প্রশ্ন হলো, সে প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য আধুনিক মুসলিমের জন্য কতটুকু উপযোগী? তাছাড়া প্রতিযুগে সাহিত্যও তার সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেক্ষাপট পাল্টায়। পরিবর্তন আসে শব্দ ভাণ্ডারে। সেসব নতুন প্রেক্ষাপটে চাই নতুন চিন্তা-ভাবনা ও নতুন শব্দ ভাণ্ডার নিয়ে নতুন সাহিত্য।সাহিত্যের ময়দানে তাই লাগাতর নবায়নটি জরুরী। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে সেটি ঘটেনি। মধ্যযুগীয় পুঁথি বা কবিতার প্রতি তাই আধুনিক যুগের মুসলিমদের আগ্রহ থাকার কথা নয়। আধুনিক কালে বাংলা সাহিত্যের যারা দিকপাল তাদের অধিকাংশই হিন্দু। ইশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, নবীন চন্দ্র, হেমচন্দ্র, বিহারীলাল, মাইকেল মধুসূদন,রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের ন্যায় বিপুল সংখ্যক সাহিত্যিকেরা বাংলা সাহিত্যকে গড়ে তোলে হিন্দুদের হিন্দু রূপে গড়ে তোলার প্রয়োজনে। তাতে মুসলিমদের জন্য মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার খোরাক ছিল না। বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্য বলতে যা বুঝাতো তা হলো মীর মোশাররফ হোসেন রচিত বিষাদ সিন্ধু ও কিছু পুঁথি সাহিত্য। তখন কোরআন-চর্চা বলতে যা হত, তা মূলত অর্থ না বুঝে স্রেফ তেলাওয়াত। এমন দরিদ্র্য জ্ঞানভাণ্ডার নিয়ে কি একটি জাতি মনের পুষ্টি পায়? বরং তাতে গড়ে উঠে ন্যাশনালিজম, সেক্যুলারিজম, সোসালিজম, ফ্যাসিবাদের ন্যায় ভয়ানক চেতনাগত রোগের উর্বর প্রেক্ষাপট।
হিন্দু রেনেসাঁর কবি-সাহিত্যিকগণ বাংলার মুসলিমদের বাঙালী রূপেও গণ্য করত না। নিজেদের ভাবনার মানচিত্রে বাঙালী মুসলিমদের জন্য তারা কোন স্থানই বরাদ্দ রাখেনি। যেমন শরৎ চন্দ্র চট্টপাধ্যায় লিখেছেন, “আমাদের স্কুলে আজ বাঙালী ও মুসলমানদের মাঝে খেলা”। তাঁর এই একটি মাত্র বাক্যেই ফুটে উঠেছে সে আমলে বাঙালী রূপে কাদেরকে বুঝানো হত। নীরদচন্দ্র চৌধুরী লিখেছেন, “(অনুবাদঃ ১৯০৫ সালের আগে মুসলমানদের প্রতি হিন্দু ভদ্রলোকদের আচরণ চার রকম ছিল। … আমাদের চতুর্থ অনুভূতিটি ছিল মুসলিম প্রজাদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষপূর্ণ, তাদেরকে আমরা গৃহপালিত পশু মনে করতাম। শব্দগুলো শক্ত,তবে সত্য।” –( Sarker, Sumit; 1973)।এমন ঘৃণাপূর্ণ চেতনা শুধু আচরণে নয়,তাতে পরিপূর্ণ ছিল হিন্দুদের রচিত সাহিত্য ও রাজনীতি।হিন্দু সাহিত্যিকদের রচিত বই পড়ে কেউ কি তাই মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার আত্মপ্রত্যয় পায়? বরং তাতে মৃত্যু ঘটে মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার প্রেরণা। ইসলামী চেতনার সে মৃত্যুদশাটি তাই এত প্রবল রবীন্দ্রভক্ত বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের মাঝে।
জনগণের মাঝে ধর্মপ্রেম, দেশপ্রেম, উচ্চতর মূল্যবোধ ও সভ্য রীতিনীতি গড়ে তোলা কাজটি রাজনৈতিক নেতাদের নয়। প্রশাসনেরও নয়। মানব গড়া ও দেশ গড়ার সে বিশাল জিহাদটি তো হয় বুদ্ধিবৃত্তির রণাঙ্গনে। সে জিহাদে মূল হাতিয়ার হলো পবিত্র কোরআন ও যুগোপযোগী ইসলামী সাহিত্য। বুদ্ধিবৃত্তির রণাঙ্গনের লড়াকু মুজাহিদগণ হলেন বিজ্ঞ জ্ঞানীগণ। ইসলামে তাই জ্ঞানীর কলমের কালীকে বিশাল মর্যাদা দেয়া হয়েছে।তাদের মৃত্যুকে তূলনা করা হয়েছে আসমান থেকে একটি নক্ষত্র খসে পড়ার সাথে। বুদ্ধিবৃত্তির এ অঙ্গণ থেকেই রণাঙ্গনের শহীদ পয়দা হয়। অথচ সে বুদ্ধিবৃত্তিক রণাঙ্গনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ছিল বিশাল শূন্যতা। বরং সে অঙ্গন অধিকৃত হয়েছিল ইসলামের শত্রু পক্ষের হাতে। তাদের অধিকাংশ ছিল সেক্যুলারিস্ট, সোসালিস্ট ও জাতীয়তাবাদী। অনেকে ছিল পৌত্তলিক এবং অখণ্ড ভারতে বিশ্বাসী। বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে তারাই বিজয়ী হয়েছে। ফলে রাজনীতির রণাঙ্গনে পর্যাপ্ত মুজাহিদ জুটেনি। বরং সৃষ্টি হয়েছে পৌত্তলিক কাফেরদের অস্ত্র নিয়ে ভারেতর পাশে যুদ্ধ লড়ার হাজার হাজার সৈনিক। ফলে বাঁচেনি সাতচল্লিশের পাকিস্তান।
আলাদা একটি রাষ্ট্রের জন্য শুধু পৃথক ভূগোল হলে চলে না, আলাদা সাহিত্যও সে জন্য অপরিহার্য। বিশেষ করে রাষ্ট্র যদি পাকিস্তানের ন্যায় একটি আদর্শিক রাষ্ট্র হয়। সাহিত্য অভিন্ন হলে চেতনাও অভিন্ন হয়। তখন বিলুপ্ত হয় ভিন্ন রাজনীতি ও ভিন্ন ভূগোলের সাধ। এরই প্রমাণ, বাংলাদেশের বাঙালী সেক্যুলারিস্টগণ। তাদের চেতনার ভূগোলটি ভারতের সাথে এতোটাই মিশে গেছে যে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রই তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। ১৯৪৭’য়ের পূর্বে একই অবস্থা ছিল কংগ্রেসী মুসলিমদের। তাদের চেতনার রাজ্যটি হিন্দুদের থেকে অভিন্ন হওয়ায় তারাও সেদিন স্বাধীন পাকিস্তানের প্রয়োজনীতা বুঝেনি। অথচ হিন্দু ও মুসলমানের মাঝে সাহিত্যের দুটি ভিন্ন ধারা শুরু থেকেই বহমান। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও শরৎ চন্দ্রে এসে সাহিত্যের সে হিন্দু ধারাটি শেষ হয়নি, বরং বলবান হয়েছে। শ্রী কৃষ্ণ কীর্তন, মনসা মঙ্গল বা চৈতন্য দেবের ভক্তি মূলক গান বাংলার হিন্দুদেরকে মুসলিম হওয়া থেকে সফল ভাবে রুখেছে। বাঙালী মুসলিম জীবনে সে হিন্দুধারাই প্রবল ভাবে বিজয়ী হয়েছে। বাংলাদেশের স্কুল কলেজে পবিত্র কোরআনের আয়াত পাঠ তাই বাধ্যতামূলক নয়, বাধ্যতামূলক হলো রবীন্দ্রনাথের “আমার সোনা বাংলা” গান। মুসলিম জনগণের জীবনে হিন্দু সাহিত্যকে এভাবে প্রতিষ্ঠা দিলে তাদের মুসলিম থাকাই শুধু বিপন্ন হয় না, বিপন্ন হয় মুসলিম দেশের অস্তিত্বও। পাকিস্তান একাত্তরে ভেঙ্গে গিয়ে বস্তুত সেটিই প্রমাণ করে গেছে। এধারাটি অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশও যে বিলুপ্ত হবে -তা নিয়েও কি কোন সন্দেহ আছে?
অধিকৃত চেতনা
ব্যক্তির কর্ম ও রাজনীতি দৈহিক গুণাগুণে পরিচালিত হয় না; পরিচালিত হয় তার চেতনা বা ভাবনার গুণে। এবং সে চেতনা বা ভাবনার রাজ্যে হুকুমটি চলে ধ্যান-ধারনা বা দর্শনের। তাই শুধু দেশের ভুগোল পাহারা দিলে চলে না, পাহারা দিতে হয় চেতনার ভূগোলকেও। আর সে চেতনার ভুগলোকে প্রতিরক্ষা দেয় বুদ্ধিবৃত্তিক যোদ্ধারা। সেটি করে সাহিত্য বা লেখনির মাধ্যমে। এ যোদ্ধারাই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল। বাঙালী মুসলিমদের বড় ব্যর্থতাটি হলো, দেশটিতে সেরূপ বুদ্ধিবৃত্তিক যোদ্ধা সৃষ্টি হয়নি। ফলে গড়ে উঠেনি ইসলামী দর্শনপুষ্ট সাহিত্য। ফলে অনায়াসেই শত্রুদের হাতে অধিকৃত হয়েছে বাঙালী মুসলিমের চেতনার ভূগোল। আর তাতে মহাসংকটে পড়েছে ইসলামী চেতনা নিয়ে বাঙালী মুসলিমের বেড়ে উঠাটি। এ ব্যর্থতার কারণেই হিন্দুদের রচিত বিশাল সাহিত্য পেয়েছে মুসলিম মননের খালি জায়গাটি সহজে দখলে নেয়ার। তাতে দখলে গেছে বাঙালী মুসলিমের রাজনীতি ও সংস্কৃতিও। এতে বাঙালী হিন্দুর চেতনার সাথে একাকার হয়েছে বাঙালী মুসলিমের চেতনা। এজন্যই সংস্কৃতি, রাজনীতি ও ধ্যানধারণা বিচারে সেক্যুলার বাঙালী মুসলিমকে বাঙালী হিন্দু থেকে আলাদাটি করাটি দুরুহ। অথচ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেরূপ বিপর্যয় পশ্চিম পাকিস্তানে সৃষ্টি হয়নি। সেখানেও জাতীয়তাবাদী ছিল, সোসালিস্ট ছিল এবং প্রচুর বিচ্ছিন্নতাবাদীও ছিল। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সফল লড়াই লড়েছে এবং এখনো লড়ছে সেদেশের আলেম-উলামা ও ইসলামী বুদ্ধিজীবীগণ। ফলে একাত্তরে বাঙালী মুসলিমের জীবনে যেমন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধিকৃতি এসেছিল সেটি পশ্চিম পাকিস্তানীদের জীবনে আজও আসেনি।
কলেরা ও যক্ষার ন্যায় সংক্রামক ব্যাধির মহামারি থেকে বাঁচতে হলে ভ্যাকসিন নিতে হয়। সেটি অবিকল সত্য কুফরি, শিরক, মুনাফিকির জীবাণু থেকে বাঁচার ক্ষেত্রেও। এক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের কাজ করে ইসলামী জ্ঞান। সে জ্ঞানকে কোরআন-হাদীস ও ইসলামী দর্শনের জ্ঞান হতে হয়। ভ্যাকসিনের সে কাজ কি হিন্দুদের রচিত সাহিত্যে সম্ভব? তাতে তো বরং উল্টোটি হয়। চেতনায় তখন শিরক ও কুফরির জীবাণু ঢুকে। তখন বেড়ে উঠে ইসলামের বিরুদ্ধে ইম্যুনিটি বা প্রতিরোধের ক্ষমতা। বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের ক্ষেত্রে তো সেটিই হয়েছে। তাদের চেতনায় তাই ইসলাম বাঁচেনি। বরং তারা দাঁড়িয়েছে ইসলামের প্রবল প্রতিপক্ষ রূপে। ঈমান বাঁচানোর সে গুরুতর বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই অনেক বাঙালী মুসলিম সেদিন উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করা পক্ষে মত দিয়েছিলেন। সে চিন্তাটি ছিল বাঙালী মুসলিমের মন ও মননকে ইসলামী চেতনায় সমৃদ্ধ করার প্রেরণা থেকে। তাদের মাথায় বাঙালীর ক্ষতির চিন্তা ছিল না। বাঙালীর মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার নিয়েতও ছিল না। কিন্তু তাদের সে সদিচ্ছার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা হয়নি। বরং তাদেরকে চিত্রিত করা হয়েছে বাঙালী ও বাংলা ভাষার শত্রু রূপে। এটি ছিল তাদের নিয়তের উপর হামলা। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ ভাষাটি থেকে ঈমানদার ব্যক্তিগণ পুষ্টি পাক এবং তাদের চেতনার ভূমিতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা পাক -সেটি তারা চায়নি।
বিভক্তির দেয়াল
মিশরের জনগণ যদি ইসলাম গ্রহণের সাথে আরবী ভাষা গ্রহণ না করতো -তা হলে কি তারা কোরআনের এতো সান্নিধ্যে আসতে পারতো? বরং ভাষার নামে বিভক্তির একটি বিশাল দেয়াল তখন থেকেই যেত। যেমন রয়ে গেছে ইরানী বা তুর্কীদের সাথে আরবদের। আরবী ভাষা থেকে মিশরীয় যেমন লাভবান হয়েছে,তেমনি আরবী ভাষাও লাভবান হয়েছে মিশরীয়দের ভাষাচর্চা ও জ্ঞানচর্চা থেকে। আধুনিক যুগে আরবী ভাষায় জ্ঞানচর্চা ও বুদ্ধিবৃত্তিতে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের অধিকাংশই মিশরীয়। এক সময় মুসলিম বিশ্বে জ্ঞানচর্চায় নেতৃত্ব ছিল ইরানীদের হাতে। বড় বড় বিজ্ঞানী ও মনিষীর জন্ম হয়েছিল ইরানে। তাদের অবদানের কথা স্বীকার করে প্রখ্যাত সমাজ-বিজ্ঞানী ইবনে খলদুন লিখেছিলেন, ইসলামের জন্ম আরবে, কিন্তু ইসলামী সভ্যতার জন্ম ইরানে। তখন ইসলামী বিশ্বের সাথে তাদের সংযোগের মাধ্যম ছিল আরবী ভাষা। আল রাযী, ইবনে সিনা, আল ফারাবী, আত তাবারী,গাজ্জালীর ন্যায় ইসলামের ইতিহাসের বহু প্রখ্যাত মনিষীর জন্ম ইরানে। তাদের লিখনীর ভাষা ছিল আরবী। ইমাম আল গাজ্জালী একমাত্র কিমিয়ায়ে সা’দাত ছাড়া সমুদয় বই লিখেছেন আরবীতে। ইরানের কবিরাও কবিতা লিখতেন আরবীতে। আরবী ভাষার কারণে ইরানীরাও সে সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি করেছিল। অপরদিকে তারাও সমৃদ্ধ করেছেন আরবী ভাষাকে। তখন আরবী ভাষা ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাষা। ভাষাগত সে সংযোগটির কারণে তারা যেমন অন্যদের থেকে জ্ঞানার্জনের সুযোগ পেয়েছিল, তেমনি সুযোগ পেয়েছিল মুসলিম জাহানের অন্যদের রাজনীতি,শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করার। আব্বাসীয় খলিফাদের আমলে -বিশেষ করে খলিফা মামুনুর রশিদের আমলে রাজনীতি চলে যায় ইরানীদের হাতে। কিন্তু পরে আরবী ভাষার সাথে সংযোগ ছিন্ন করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইরানীরা। ফার্সী ভাষাকে জিন্দা করে তারা শুধু মুসলিম একতাকেই বিনষ্ট করেনি, আবর বিশ্বের সাথে নিজেদের সংযোগটিও ছিন্ন করেছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ, জনগণ বিচ্ছিন্ন হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত কোরআন থেকে। সেক্যুলার বাঙালী জাতীয়তাবাদীগণ অবাঙালী মুসলিমদের থেকে বিচ্ছেদের দেয়াল খাড়া করতে চেয়েছিল এবং তাতে তারা সফলও হয়েছে। অথচ উর্দু ভাষাকে সমৃদ্ধ করার কাজে বাঙালীদের অবদানও কি কম ছিল? বহু বাংলাভাষী উর্দুতে কবিতা লিখেছেন। মওলানা আবুল কালাম আজাদের বিখ্যাত পত্রিকা আল হিলালসহ উর্দু ভাষায় বহু পত্র-পত্রিকা এবং উর্দু বই ছাপা হত বাংলার নগরী কলকাতা থেকে। উর্দু কবিতার লালন ভূমি লক্ষৌ, দিল্লি এলাহাবাদ ও দক্ষিণ ভারতের হায়দারাবাদ হলেও গদ্যচর্চার কাজটি জোরশোরে শুরু হয় কলকাতা থেকে। কলকাতা পরিণত হয়েছিল ভারতীয় মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের কেন্দ্রভূমি। আর সে কারণেই বাংলা পরিণত হয় মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের মূল দুর্গ।
কথা বলা বা ভাব প্রকাশে সাহায্য করার পাশাপাশি ভাষার গুরুত্বপূর্ণ কাজ বু্দ্ধিবৃত্তিক,অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক,ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজন মেটানো।পশ্চিম বাংলার বাঙালীদের সে প্রয়োজন মিটাতে বাংলা ভাষার পাশাপাশি হিন্দি এবং ইংরেজী শিখতে হয়।ইউরোপীয়দেরও শিখতে হয় কয়েকটি ভাষা।মাতৃভাষা রূপে শতাধিক ভাষা বেঁচে আছে ব্রিটেনে।কিন্তু সেসব ভাষা মায়ের ভাষা হলেও শিক্ষা ও সংস্কৃতির ভাষা নয়। বিলেতে শিক্ষা,সংস্কৃতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যর ভাষা রূপে যেটির চর্চা হচ্ছে সেটি ইংরাজী।একই কারণে বাংলার শিক্ষিতজনেরা এক সময় ফার্সি ও উর্দু শিখতো।তাই অখণ্ড পাকিস্তানেও বাংলার পাশাপাশি উর্দু শেখারও প্রয়োজন ছিল।সেটি যেমন রাজনৈতিক কারণে,তেমনি ইসলামী চেতনা নিয়ে বেড়ে উঠার প্রয়োজনে।পাকিস্তানের পাঞ্জাবী,সিন্ধি,পাঠান ও বেলুচ শিশুরাও একারণে উর্দু শিখছে। এতে কি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বিজ্ঞানী হওয়ার ক্ষেত্রে তারা কি বাঙালীদের চেয়ে পিছিয়ে আছে? তাদের মাতৃভাষাগুলিও কি তাতে বিলুপ্ত হয়েছে? অথচ যুক্তি দেখানো হয়েছিল, বাঙালী কিশোরদের এতো সামর্থ্য নেই যে উর্দুর ন্যায় একটি নতুন ভাষা শিখবে। এরূপ অভিমত আদৌ সঠিক ছিল না।এমন ধারণার ভিত্তি ছিল শিশুর মেধাগত সামর্থ্য নিয়ে ভুল ধারণা।শিশুর ভাষা শেখার সামর্থ্য নিয়ে পাশ্চাত্য দেশগুলিতে বহু গবেষণা হয়েছে। নিউয়র্কের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গবেষণা করে দেখেছে শিশুরা একই সাথে ইংরেজী,জার্মান,চাইনিজ,স্পানীশ -এরূপ চারটি ভাষা একত্রে শিখতে পারে।
উর্দু ভাষা শিক্ষায় বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের অনীহার মূল কারণ,উর্দুর বিরুদ্ধে গভীর বিদ্বেষ এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রতি শত্রুতা।যারা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে বিরোধীতা করেছিল তারা কখনোই চায়নি উর্দু ভাষাটি পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মানুষের মাঝে সেতু-বন্ধন গড়তে সহায়ক ভূমিকা পালন করুক।ফলে শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে উর্দুর বিরুদ্ধে একটি শত্রুপক্ষ সক্রিয় ছিল।তাদের দ্বারা ভাষা আন্দোলন ব্যবহৃত হয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নাশকতার কাজে।অথচ পশ্চিম বাংলার বাঙালীরা হিন্দির বিরুদ্ধে এতোটা নীচে নামেনি।সেখানে বাঙালী ছাত্র-ছাত্রীরা বাংলা ও ইংরেজীর সাথে হিন্দিও শিখছে;সেটি ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মানুষের সাথে একাত্ম হওয়ার প্রয়োজনে।অখণ্ড ভারত বাঁচাতে পশ্চিম বাংলার বাঙালী হিন্দুদের মাঝে যে প্রবল আগ্রহ,সেরূপ আগ্রহ পূর্ব পাকিস্তানীদের মাঝে পাকিস্তান বাঁচাতে ছিল না।অথচ হিন্দির চেয়ে অনেক সমৃদ্ধ ভাষা হলো উর্দু। ব্রিটিশ আমলেও বাংলার মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষার মাধ্যম ছিল উর্দু।আল্লাহতায়ালার দরবারে সকল কাজকর্মের প্রতিদান নির্ধারিত হয় নিয়তের ভিত্তিতে।নিয়ত যেখানে ভাষাকে কেন্দ্র করে মুসলিম দেশের ঐক্য ও সংহতির মূলে আঘাত হানা -তখন সেটি শুধু রাজনৈতিক আন্দোলন থাকে না,যে পাপ কবিরা গোনাহতে রূপ নেয়।সে নাশকতাটি শুধু নিজ দেশের বিরুদ্ধে হয় না,সংঘটিত হয় নিজ আখেরাতের পরিণামের বিরুদ্ধেও।ভাষার নামে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সেটিই হয়েছে।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018