অধ্যায় বারো: পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা এবং বাঙালী মুসলিমের লাভ-লোকসান

বৈষম্যের শুরুটি শতবছর আগে

ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের মাঝে শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ও বুদ্ধিবৃত্তির ন্যায় নানা ক্ষেত্রে তুলনামূলক ভাবে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়েছিল বাঙালী মুসলিমগণ। দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, বিহার -এসব প্রদেশে মুসলিমদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৫ বা ২০ ভাগের বেশী ছিল না। কিন্তু তারা শিক্ষাদীক্ষায় হিন্দুদের চেয়েও অগ্রসর ছিল। এলাহাবাদ, পাটনা, দিল্লি, বোম্বাইয়ের আদালতগুলোতে অনেক প্রতিষ্ঠিত মুসলিম আইনজ্ঞ ছিলেন। সেরূপ অবস্থা কলকাতায় ছিল না। মুষ্টিমেয় যে ক’জন বাঙালী মুসলিম লেখাপড়া শিখেছিল তাদের পক্ষে প্রতিবেশী অগ্রসর হিন্দুদের সাথে প্রতিযোগীতা করে চাকরিতে প্রবেশ করা এতোটা সহজ ছিল না। সহজ ছিল না শিল্প বা ব্যবসা-বাণিজ্যে সামনে এগুনো। পূর্ব থেকে প্রতিষ্ঠিত হিন্দুরা তাদের জন্য সামান্যতম স্থানও ছেড়ে দিতে রাজী ছিল না। চিত্তরঞ্জন দাশ একবার চাকরিতে মুসলমানদের জন্য সংখ্যানুপাতে বরাদ্দের কথা বলেছিলেন, কিন্তু বর্ণহিন্দুগণ সে প্রস্তাব তৎক্ষণাৎ নাকোচ করে দেয়। আজকের ভারতে আজও তারা দিচ্ছে না। ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা শতকরা ১৫ ভাগ হলে কি হবে, সরকারি চাকরিতে শতকরা ৩ ভাগও তারা নয়। ফলে ভারতের মুসলমানগণ আজ সে দেশের নমশুদ্র বা হরিজনদের থেকেও পশ্চাদপদ। সে ঘোষণাটি এসেছে সাবেক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কর্তৃক স্থাপিত সাচার কমিশনের রিপোর্টে।

বাঙলার মুসলিমদের পিছিয়ে পড়ার কিছু ঐতিহাসিক কারণও রয়েছে। উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের শুরু বাংলা থেকেই। সেটি ১৭৫৭ সালে। অপর দিকে দিল্লি ও তার আশে পাশের উত্তর ভারত পরাধীন হয় ১৮৫৭ সালে অর্থাৎ বাংলার পরাধীন হওয়ার ১০০ বছর পর। পরাধীনতার এই একশ’ বছরে বাংলার মুসলমানগণ শুধু পিছিয়েছে, এগুনোর সুযোগ পায়নি। কারণ, তাদেরকে এগুনোর সুযোগ না দেয়াই সে সময়ের ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের পলিসি ছিল। তারা বরং সুযোগ করে দিয়েছিল হিন্দুদের। ভারতের উপর ব্রিটিশ অধিকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে লোকবলের প্রয়োজন ছিল। তারা সে লোকবল সংগ্রহ করেছে হিন্দুদের থেকে। মুসলিম শাসকদের থেকে সাম্রাজ্য কেড়ে নেয়ার কারণে মুসলিমগণ ব্রিটিশদের শত্রু মনে করতো,তাদের ন্যায় আগ্রাসী কাফের শক্তিকে সহায়তা দেয়াকে তারা শরিয়তের দৃষ্টিতে হারাম মনে করেছে।তেমনি ব্রিটিশেরাও শত্রু ভাবতো মুসলিমদের। মুসলিমগণ ব্রিটিশ স্বার্থের হেফাজতে কাজ করবে -সেটি বোধগম্য কারণেই তারা বিশ্বাস করেনি। ফলে উভয়ের মাঝে সহযোগিতার মানসিক প্রেক্ষাপট ছিল না। কিন্তু হিন্দুদের ক্ষেত্রে সেটি ছিল অর্থ ও প্রতিপত্তি লাভের সুযোগ। হিন্দুদের খুশি করে দলে রাখার জন্য ব্রিটিশ শাসকেরা মুসলিমদের থেকে জমি ছিনিয়ে হিন্দুদের জমিদার বানানো শুরু করে। মুসলিমদের সর্বক্ষেত্রে দাবিয়ে রাখার জন্য হিন্দু জমিদারগণ ব্যবহৃত হয় ব্রিটিশের লাঠিয়াল রূপে। শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলিমদের অনগ্রসর রাখার জন্য মকতব-মাদ্রাসার নামে পূর্ব থেকে বরাদ্দকৃত খাজনামুক্ত জমিও ছিনিয়ে নেয়া হয়। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ম্যাক্সমুলারের মতে ইংরেজদের হাতে বাংলা অধিকৃত হওয়ার আগে বাংলার বুকে ৪০ হাজারের বেশী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু সেগুলির হাত থেকে বরাদ্দকৃত জমি কেড়ে নেওয়ায় সবগুলিই  বিলুপ্ত হয়ে যায়। ব্রিটিশের আগমনের আগে রাষ্ট্র ভাষা ও মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তির ভাষা ছিল ফার্সি। ফার্সি ভাষার বদলে ইংরেজী ভাষা চালু হওয়ায় শুরু হয় মারাত্মক বুদ্ধিবৃত্তিক অপুষ্টি। এভাবে মুসলিম সমাজে দ্রুত বৃদ্ধি পায় নিরক্ষরতার সাথে অশিক্ষা।

বাংলার মুসলিমদের ঘাড়ে ছিল গোলামী ও শোষণের দুটো জোয়াল। একটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের। অপরটি অত্যাচারি হিন্দু জমিদারদের। বাংলার মুসলিমগণ গোলামীর প্রথম ১০০ বছর যাবত স্রেফ দ্রুত নীচে নেমেছে। দিল্লি ও উত্তর ভারতের মুসলিমদের সৌভাগ্য যে সে সময় ব্রিটিশের গোলামী মুক্ত থাকার কারণে অন্তত সে ১০০ বছর যাবত নীচে নামার বিপর্যয় থেকে তারা রক্ষা পায়। অতি ধীরে হলেও শিক্ষা-দীক্ষায় সামনে এগুনোর ধারা তখনও তারা জারি রাখে। দিল্লি, লক্ষৌ, আগ্রা, লাহোর ও অন্যান্য উত্তর ভারতীয় জনপদ যখন স্বাধীনতা হারায় তখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আসে। ব্রিটিশগণ তখন বুঝতে পারে একমাত্র হিন্দুদের উপর নির্ভরশীল হওয়াটি তাদের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে হিন্দুদের হাতে পুরাপুরি জিম্মি হওয়া থেকে বাঁচার গরজেই মুসলিমদের থেকেও তারা লোক নিয়োগ শুরু করে। এজন্য মুসলিমদের শিক্ষিত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। বাংলা পরাধীন হওয়ার ১০০ বছর পর তারা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করে ১৮৫৭ সালে। অথচ দিল্লি কবজা করার মাত্র ২১ বছর পরই মুসলমানদের জন্য আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের অনুমতি দেয়। গুণগত মান দিয়ে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় ছিল উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্ব্রিজ ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষকদের ডেপুটেশনে এখানে নিয়োগ দেয়া হত। ফলে উত্তর ভারতের মুসলিমগণ দ্রুত সামনে এগুনোর সুযোগ পায়। সুযোগ পায় ব্রিটিশ প্রশাসনের বড় বড় পদে প্রবেশের। ১৮৬০ সালে লাহোরে প্রতিষ্ঠিত হয় কিং এডওয়ার্ড মিডিক্যাল কলেজ এবং ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৬ সালে। তাছাড়া বাংলার যে অংশ নিয়ে পাকিস্তান গড়া হয় সেটি ছিল বাংলার সবচেয়ে অনুন্নত এলাকা। এ এলাকাটি ব্যবহৃত হতো কলকাতা কেন্দ্রীক পশ্চিম বাংলার কাঁচামালের জোগানদার রূপে। ফলে ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন দেশটির যাত্রাই শুরু হয় একশত বছরের ব্রিটিশ শোষনের ফলে সৃষ্ট পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মাঝে বিশাল বৈষম্য নিয়ে। সেটি যেমন শিক্ষাখাতে,তেমনি অর্থনীতিতে। কারণ শিক্ষাগত উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন তো একত্রে চলে। অথচ এ বৈষম্যের জন্য বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাগণ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ও হিন্দু জমিদারদের শোষণকে দায়ী না করে পাকিস্তানকে দোষারোপ করতে শুরু করে।

 

মাউন্টব্যাটেনের গ্রামীন বস্তি

উত্তর ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত এলাকার উপর ঔপনিবেশিক শাসন শুরুর শত বছর আগেই নির্মম ঔপনিবেশিক শোষণে বাংলার উপর দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ নেমে আসে।সে দুর্ভিক্ষে প্রায় এক তৃতীয়াংশ বাঙালীর মৃত্যু ঘটে।বাঙালী জনগণ তখন অর্থনৈতিক রক্তশূণ্যতায় নির্জীব।বিশেষ করে বাংলার মুসলিম জনগণ।ব্রিটিশ শাসনের ১৯০ বছরে যা কিছু শিল্পোন্নয়ন ও শিক্ষাউন্নয়ন হয় -সেটি কলকাতা ও তার আশেপাশে।পূর্ব পাকিস্তান ভূক্ত পূর্ব বাংলায় নয়।পূর্ব বাংলার মূল অর্থকরি ফসল ছিল পাট।কিন্তু পূর্ব বাংলায় কোন পাটকল ছিল না।এমন কি ছিল না কোন হাইড্রোলিক জুট প্রসেসিং কারখানা।সকল পাটকল ও পাট প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রী ছিল কলকাতায়।ফলে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানের সমুদয় পাট কলকাতায় মারোয়ারিদের কাছে পাঠাতে হত।এবং তাদের মাধ্যমেই পাকিস্তানের পাটজাত দ্রব্য আন্তর্জাতিক বাজারে যেত।ফলে পাটের সমুদয় রপ্তানি আয় নির্ভর করতো ভারতের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর।তখন অবস্থা কতটা নাজুক ছিল সেটি বুঝার জন্য এটিই যথেষ্ট যে,ভারতীয় বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের প্রধান পাকিস্তানী দলের প্রধানকে একবার দম্ভভরে বলেছিলেন,“ভারতের কাছে বিক্রয় ছাড়া পাট নিয়ে আপনারা আর কি করতে পারেন? পুড়িয়ে দিতে পারেন,অথবা বঙ্গোপসাগরে ফেলতে পারেন।” –(C. M. Ali, 1967)।উল্লেখ্য যে,পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলার সে দৈন্যদশা থাকেনি।কয়েক বছরের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠা পায় বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ পাটকল;সে সাথে ষাটের বেশী বড় বড় পাটকল।দেশটি পাটজাত দ্র্রব্য রপ্তানিতে ভারতকে ছাড়িয়ে শীর্ষস্থান দখল করে।

কংগ্রেসের ন্যায় ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীও ভারত বিভাগ ও পাকিস্তান সৃষ্টি পুরাপুরি বিরোধী ছিল।ব্রিটিশগণ যখন দেখলো পাকিস্তান মেনে না নেলে তাদের পক্ষে ভারত থেকে নিরাপদে দেশে ফেরা অসম্ভব,তখন তারা আরেক ফন্দি আঁটে।কায়েদে আযমকে জানিয়ে দেয়,ভারত ভাগ হলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ও পাঞ্জাবকেও ভাগ করা হবে।কায়েদে আযম সেটি ভাবতেও পারেননি।কারণ,বাংলা ভাগ হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পূর্ব বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠি অর্থাৎ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ।লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ভাষায় পূর্ববাংলা ছিল “The most useless part, a rural slum”। তিনি কায়েদে আযম মহম্মদ আলী জিন্নাহকে বলেন,পূর্ব বাংলা হবে পাকিস্তানের জন্য বোঝা। অতএব জিন্নাহর কাছে যুক্তি পেশ করেন,বাংলার বিভক্তি এড়াতে হলে ভারত বিভক্তি ও পাকিস্তানের দাবী ছাড়তে হবে।–(Viceroy’s Ninth Miscellaneous Meeting, 1947 )। তখন বাংলার গভর্নর ছিলেন R G Casey। মাউন্টব্যাটেনের ন্যায় তিনিও একই যুক্তি পেশ করেন বাংলার মুসলিম লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দীর ও অন্যান্যদের কাছে। তাদেরকে তিনি পাকিস্তানের দাবী ছেড়ে অখণ্ড ভারতের পক্ষ নিতে পরামর্শ দেন।–(Transfer of Power, London, 1970)। বাংলার বিভক্তি যে পূর্ব বাংলার জন্য বিপদজনক সেটি কারো কাছেই কোন দুর্বোধ্য বিষয় ছিল না।বিভক্তি এড়াতে বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী কংগ্রেসের প্রাদেশিক সভাপতি শরৎ বোসের সাথে মিলে স্বাধীন অবিভক্ত বাংলার প্রস্তাব রাখেন।কিন্তু ভারতীয় কংগ্রেস নেতা গান্ধি ও নেহেরু সেটিরও বিরোধীতা করেন।

 

খুলে যায় নতুন দিগন্ত

পাকিস্তান সৃষ্টির সাথে সাথে পূর্ব বাংলার দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তানদের সামনে খুলে যায় সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। সামনে এগুনোর জন্য তারা পায় প্রতিযোগিতা-মুক্ত এক বিশাল খালী জায়গা। শুরু হয় বাংলার সমগ্র ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী সোসাল মবিলিটি। বিশাল বটবৃক্ষের পাশে ছোট গাছ বাড়তে পারে না। এ জন্য চাই আলাদা পরিচর্যা। হিন্দু জমিদার ও মহাজনদের সন্তানদের সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলা মুসলিম কৃষক পরিবারের বেড়ে উঠাটি ব্রিটিশ আমলে প্রায় অসম্ভব ছিল।আজও সেটিই হচ্ছে ভারতে। পূর্ব বাংলার পশ্চাদপদ মুসলমানদের জন্য পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা এক মহাসুযোগের দরজা খুলে দেয়। ফলে পাকিস্তান আমলের মাত্র ২৩ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যে বিপুল সংখ্যক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, বিজ্ঞানী, উকিল ও অন্যান্য পেশাদার সৃষ্টি করতে সমর্থ হয় ভারতের ১৬ কোটি মুসলমান তার দশ ভাগের এক ভাগও সৃষ্টি করতে পারেনি। অথচ কি অদ্ভুদ আবিস্কার! আওয়ামী বাকশালী চক্রের কাছে পূর্ব বাংলার এ সময়টি সবচেয়ে শোষণমূলক যুগ রূপে চিত্রিত হয়। এ সময়টাকে তারা বলে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানী শাসনের যুগ। যদিও সে ঔপনিবেশিক (!)শাসকদের মাঝে প্রধানমন্ত্রী রূপে তাদের নিজ দলের নেতা জনাব সোহরাওয়ার্দীও ছিলেন।

আওয়ামী বাকশালী চক্র এতোটাই চিন্তাশূন্য যে, পার্শ্ববর্তী ভারতীয় মুসলিমদের সাথে তুলনামূলক বিচারে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানী মুসলিমরা যে অনেক দ্রুত সামনে এগিয়ে গেল -সে কথা তারা বিবেচনায় আনতে রাজী নয়। ভারতে হাজার হাজার মুসলিম যুবক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ডিগ্রি নিয়েও আজ বেকার। সেদেশে মুসলিমদের চাকরি পাওয়াই কঠিন। ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে দাঁড়াতে গেলেই উগ্র হিন্দুদের সন্ত্রাসের কবলে পড়তে হয়। তখন জান নিয়ে বাঁচাই দায় হয়ে যায়। অথচ পাকিস্তানে যোগ দানের ফলে বাঙালী মুসলিমদের ভাগ্য খুলে যায়। বাঙালী মুসলিমের দ্রুত উপরে উঠার একটি উদাহরণ দেয়া যাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. সাজ্জাদ হোসেন সাহেবের স্মৃতিচারণ থেকে। তিনি লিখেছেন, “হোসেন আলীকে চিনতাম ১৯৪৭ সাল থেকে। ১৯৪৭ সালে আমরা যে কজন তরুণ শিক্ষক পূর্ববঙ্গ অঞ্চল থেকে সিলেটের এম,সি, কলেজে যোগ দিয়েছিলাম হোসেন আলী তাদের অন্যতম। তার ডিগ্রি ছিল কেমিস্ট্রিতে। সিলেটের আম্বরখানায় আমি যে বাসা ভাড়া করেছিলাম প্রথম কয়েকদিনের জন্য তিনি সেখানে উঠে এসেছিলেন। আমার সঙ্গে আরো ছিলেন ইংরেজীর অধ্যাপক মঈদুল ইসলাম। তিনি বাসায় রয়ে গেলেন। হোসেন আলী এক রিক্সাওয়ালার সাথে মেস করেন। এ সময় অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের শেষ দিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সেন্ট্রাল সার্ভিসের জন্য অনেক অফিসার রিক্রুট করা হয়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা অনুষ্ঠানের সময় ছিল না; কারণ তখনই কিছু লোক ট্রেনিং এর জন্য নিয়াগ করার প্রয়োজন দেখা দিল। এ প্রসঙ্গে বলা বোধ হয় প্রয়োজন যে, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী আই সি এস অফিসার একজনও ছিল না। সুতরাং শুধু ইন্টারভিউ করে কাউকে ফরেন সার্ভিস, কাউকে এডমিনিসট্রেটিভ সার্ভিস, কাউকে অডিট সার্ভিসে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের কলেজে কলেজে রিক্রুটমেন্ট টিম ঘুরে বেড়িয়ে লোক সংগ্রহ করে। এইভাবে হোসেন আলী পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন।… সেই হোসেন আলী নাটকীয় ভাবে (একাত্তরে) পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করলেন।-(সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন,১৯৯৩)। উল্লেখ্য, ১৯৭১য়ে হোসেন আলী কোলকাতায় পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ডিপুটি হাই কমিশনার রূপে অবস্থান করছিলেন। তিনি সে পদ ছেড়ে মুজিব নগর সরকারে যোগ দেন।

আওয়ামী লীগ সবসময়ই প্রচার চালিয়েছে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে যে বৈষম্য তা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সৃষ্টি। তারা একটি বারের জন্যও বলেনি, এ বৈষম্য বিদ্যমান ছিল ১৯৪৭ য়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব থেকেই। পূর্ব বাংলার মুসলিমগণ ছিল সমগ্র ভারতে সবচেয়ে পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠী। অথচ ষাটের দশকে এসে তারা করাচি ও লাহোরের সাথে ঢাকার তুলনা করে। কিন্তু ১৯৪৭ য়ে করাচি ও লাহোরের তুলনায় ঢাকার অবস্থাটি কি আদৌ তুলনা করার মত ছিল। ৪৭-এ ঢাকা ছিল একটি অনুন্নত জেলা শহর। আর করাচি ও লাহোর ছিল বহু বছরের পুরোন প্রাদেশিক রাজধানী শহর। লাহোর বিখ্যাত ছিল মোগল আমল থেকেই। লাহোরের বিশাল বাদশাহী মসজিদ, শালিমার গার্ডেন, বিশাল বাদশাহী কেল্লা, সম্রাট জাহাঙ্গীর ও নূরজাহানের মাজার। এ কীর্তিগুলি স্বাক্ষ্য দেয়, শহরটি মোগল আমলেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল; লাহোরের অবস্থান ছিল দিল্লির পরই।১৯৪৭’য়ে স্বাধীনতা লাভের পর ঢাকার ন্যায় লাহোর বা করাচি শহরে টিনের চালার নীচে সেক্রেটারিয়েটর দফতর খুলতে হয়নি। অথচ আওয়ামী লীগের সমর্থকগণ করাচি ও লাহোরে গিয়েই পাটের গন্ধ আবিষ্কার করত। যেন পশ্চিম পাকিস্তানের শহরগুলো গড়ে উঠেছে পাটের অর্থে।

ষাটের দশকে এসে বলা হয়,সেনা বাহিনীতে বৈষম্যের কথা। অথচ ১৯৪৭ সালে সেনাবাহিনীতে যে হিমালয় সম বৈষম্য ছিল সে কথা বলে না। সে বৈষম্যটি সৃষ্টি হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। অথচ সে ব্রিটিশ আমলকে দোষারপ না করে আওয়ামী বাকশালীগণ দায়ভার চাপায় পাকিস্তানের উপর। ১৯৪৭-যে মেজর পদমর্যদার উপরে কোন বাঙালী অফিসার ছিল না। সেটিও মাত্র একজন। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানীদের মধ্যে ছিল জেনারেল পর্যায়ের অফিসার। তাদের ছিল বহু ব্রিগেডিয়ার ও কর্ণেল। বলা হয় প্রশাসনে উর্ধতন কর্মকর্তাদের মাঝে বৈষম্যের কথা। অথচ সেটিও আকাশচুম্বি ছিল ১৯৪৭’য়ের পূর্ব থেকেই। ১৯৪৭-য়ে হিন্দু অফিসারদের দেশ ত্যাগের ফলে মহা সংকটে পড়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার। তখন রেলগাড়ী চালানোর ড্রাইভারও ছিল না। তখন ভারত থেকে আগত মোহাজির দিয়ে অফিস আদালত, রেল, পোষ্ট অফিসসহ নানা সরকারি দফতর চালাতে হয়েছে। তারা একটি বারের জন্যও এ কথা বলে না, ১৯৪৭য়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে বিশাল বৈষম্য নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ক্রমান্বয়ে কমতে শুরু করেছিল।

১৯৪৭’য়ে অধিকাংশ ডিসি, পুলিশ কর্মকর্তা, রেলকর্মচারী অবাঙালী হলেও ১৯৭০’য়ে চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছিল। প্রায় সবগুলো জেলাতেই তখন বাঙালী ডিসি ও এসডিও। এমন কি ১৯৭১’য়ে ইসলামাদে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সেক্রেটারিয়েটে শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ কর্মচারিই ছিল পূর্ব পাকিস্তানী। ১৯৭১ ঢাকার পতনের পর যে প্রায় ৪ লক্ষ বাঙালী পশ্চিম পাকিস্তানে আটকা পড়েছিল তারা নিশ্চয়ই সেখানে দিনমুজুরি করত না। তাদের বেশীর ভাগই ছিল সেখানে কেন্দ্রীয় সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারি বা সামরিক বিভাগের লোক। এমন কি লন্ডন ও নিউয়র্কের পাকিস্তানের দূতাবাদগুলোতে প্রায় অর্ধেক কর্মচারী ছিল বাঙালী। সে চিত্র স্বচক্ষে দেখেছেন ড. সাজ্জাদ হোসেন। তিনি লিখেছেন,“লন্ডনে যেমন দেখেছিলাম দূতাবাসের কর্মচারীদের প্রায় অর্ধেক বাঙালী, নিউয়র্কেও তাই এবং সম্ভবতঃ বাঙালী কর্মচারীদের অনুপাত এখানে আরেকটু বেশী ছিল। ..অনেক বাঙালী শিক্ষকও এ্যাডহক এ্যাপোয়েন্টমেন্ট পেয়ে রাতারাতি ডিপ্লোমেট পদে উন্নীত হন। বার্মায় পাকিস্তানের প্রথম এ্যামবেসেডর ছিলেন বগুড়ার সৈয়দ মোহম্মদ আলী। তিনি পরে ওয়াশিংটনে এ্যামবেসেডর নিযুক্ত হন। (ইনিই পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন।) বার্মায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত যিনি হন তিনি ঢাকার আর্মানিটোলা হাইস্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক কমর উদ্দিন আহম্মদ। পরে এই কমর উদ্দিন আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এবং লিখেন,পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের সামাজিক ইতিহাসে ইসলামের বিশেষ স্থান নেই।”-( সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, ১৯৯৩)।

 

শুরু হয় শিল্পোন্নয়ন

বৃটিশ শাসনের ১৯০ বছরে পূর্ব বাংলায় আন্তর্জাতিক মানের কোন বড় শহরই ছিল না। ছিল কিছু মফস্বলের জেলা শহর। পাট উৎপাদিত হতো পূর্ব বাংলায়। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে একটি জুটমিলও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ৪টি বস্ত্রকল ছিল। সেগুলো হলো ঢাকা জেলার চিত্তরঞ্জন কটন মিলস, লক্ষীনারায়ণ কটন মিলস, ঢাকেশ্বরী কটন মিলস এবং কুষ্টিয়ার মোহিনী মিলস। ছিল ৪টি চিনি কল। এগুলো হলো, কুষ্টিয়া জেলার দর্শনার কেরু কোম্পানী, রাজশাহী জেলার গোপালপুরের উত্তরবঙ্গ সুগার মিলস, রংপুরের মহিমগঞ্জ সুগার মিলস এবং সেতাবগঞ্জের ইস্টবেঙ্গল সুগার মিলস। সবে ধন নীলমণি এই ক’টি মাত্র মিল ছাড়া এ অঞ্চলে আর কোন শিল্পকারখানাই ছিল না। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে মাত্র ২৩ বছরে এ এলাকায় ৭৬টি জুট মিল প্রতিষ্ঠিত হয়। আদমজী জুটমিল ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাটকল। কাপড়ের কল প্রতিষ্ঠিত হয় ৫৯টি। এগুলোর সাথে প্রতিষ্ঠিত করা হয় অনেক গুলো ইস্পাত কারখানা, ঔষধের কারখানা, রাসায়নিক শিল্প ও চামড়া ও জুতার কারখানা। ..১৯৭০ সালে যে শিল্পোৎপাদন ছিল সেটি বাংলাদেশ আমলে ১৯৮০ সালেও অর্জিত হয়নি। -(এস. মুজিবুল্লাহ, ইত্তেফাক ৩/০৯/৮০)।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির সাথে তুলনা করলে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পোন্নয়নের এ হার অন্যদের চেয়ে খুব একটা খারাপ ছিল না। বরং কোরিয়ার মত দেশের সাথে তখন পাল্লা দিয়ে এগুচ্ছিল পাকিস্তান। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর শিল্প খাতে উন্নয়নের স্থলে এসেছে প্রচণ্ড ধ্বস। আদমজী জুটমিলসহ বহু বড় বড় মিল ধ্বংস হয়ে গেছে। মোহিনী মিলসহ বহু কাপড়ের মিলগুলিতে লেগেছে তালা। ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানভূক্ত এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মাত্র একটি। সেটি ঢাকায় এবং অতি ছোট আকারের। ছিল না কোন সামুদ্রিক বন্দর। ছিল না কোন মেডিকেল কলেজ, কৃষি ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়। ছিল না কোন আলিয়া মাদ্রাসা। ছিল না কোন ক্যান্টনমেন্ট। পাকিস্তান আমলের মাত্র ২০ বছরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৭টি বিশাল আকারের বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ একাত্তরের পর, বাংলাদেশের বিগত ৪৪ বছরের ইতিহাসে সে মাপের বিশাল বিশ্ববিদ্যালয় একটিও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। যা হয়েছে তা অতি ছোট মাপের; খুলনা, কুষ্টিয়া, বরিশাল ও সিলেটে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তারই উদাহরণ।

পাকিস্তান আমলের মাত্র ২৩ বছরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক মানের বিশাল আকারের ৭টি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠিত হয় বড় বড় ক্যাডেট কলেজ, জেলা স্কুল ও রেসিডেনশিয়াল মডেল স্কুল ও থানায় থানায় পাইলট স্কুল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অনেকগুলি ক্যান্টনমেন্ট। নির্মিত হয়েছে দুটি সামুদ্রিক বন্দর। ১৯৪৭য়ের আগে ঢাকা শহরে বড় আকারের কোন বিল্ডিং ছিল না। ছিল না কোন আন্তর্জাতিক মানের হোটেল। ছিল না এক হাজার মানুষ একত্রে নামাজ পড়তে পারে এমন কোন মসজিদ। জাতীয় সংসদ, কমলাপুর রেল স্টেশন, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, শাহবাগ হোটেল (এখন পিজি হাসপাতাল),শেরাটন হোটেল, হাইকোর্ট বিল্ডিং, ডিআইটি ভবনসহ শহরের বড় বড় এমারতগুলো গড়ে উঠেছিল পাকিস্তান আমলেই। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝের বৈষম্যটি যে পাকিস্তান আমলের সৃষ্ট নয়-সেটি বুঝার জন্য কি তাই গবেষণার প্রয়োজন পড়ে? সে বৈষম্য ছিল বহু শত বছরের পুরনো। কিন্তু মিথ্যাচারী মন কি সত্যকে মেনে নেয়? আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা এ বৈষম্যের জন্য ষোল আনা দায়ী করে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে। তবে সত্যকে তারা নিজেরা স্বীকার না করলে কি হবে, সেটি বেরিয়ে এসেছে এমনকি বহু ভারতীয় হিন্দু সাংবাদিকের মুখ থেকেও। সে উদাহরণও দেয়া যাক। একাত্তরের পর আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী ঢাকা থেকে নব্য প্রকাশিত “দৈনিক জনপদ” নামের একটি পত্রিকায় কলাম লিখতেন। তিনি লিখেছিলেন, ১৯৭১এর ১৬ই ডিসেম্বরের পর কোলকাতা থেকে কিছু সাংবাদিককে হেলিকপ্টারে তাড়াহুড়া করে ঢাকায় পাঠানো হয়। কয়েকজন ভারতীয় সাংবাদিকের সাথে আব্দুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ও ছিলেন। তাঁর সাথের ভারতীয় সাংবাদিকগণ ঢাকায় নেমে অবাক। তারা আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী  জিজ্ঞেস করেছিলেন,“দাদা, আপনি আপনাদের কোলকাতাকে দেখেছেন। কোলকাতায় যা কিছু গড়া হয়েছে সেগুলি ১৯৪৭ এর আগে। ১৯৪৭ য়ের পর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার খুব কমই যোগ করেছে। আপনাদের ঢাকায় তো অনেক কিছু হয়েছে। এরপরও আপনারা কেন স্বাধীন হলেন?”

অধ্যাপক আবু জাফর লিখেছেনঃ “দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন শুরু হলো আমি কলকাতা চলে যাই।.. আমরা গেলাম কলকাতা বেতারে। দেবদুলাল বন্দোপ্যাধ্যায়ের সঙ্গে আমার অনেকদিন থেকে পত্র-যোগাযোগ ছিল। .. বেতার থেকে বিদায় নিয়ে গেলাম কবি বুদ্ধদেব বসুর বাসাতে। .. বুদ্ধদেব এবং প্রতিভা বসু দু’জনার কাছে আমরা আশাতীত ভাবে সমাদৃত ও আপ্যায়ীত হলাম। ..বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের আগ্রহ ও কৌতুহলো খুব স্বাভাবিক কারণেই সীমাহীন। আর আমরা এরকম দু’জন উন্মুখ ও উৎসাহী শ্রোতা পেয়ে আমরা দুইজন সহযাত্রী অবিরল ভাবে স্বাধীনতা-যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে চলেছি। কিন্তু হঠাৎ একটু ছন্দপতন ঘটলো। কথার ফাঁকে বুদ্ধদেব বললেন, কী এমন হলো যে তোমরা হঠাৎ পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে চাইছো। তোমাদের কত দিকে কত উন্নতি হচ্ছিল, ভালোই তো ছিলে। আমরাও তে দিল্লীর অনেক অন্যায়-অবিচারের শিকার, তাই বলে কি আলাদা হয়ে যাবো?-(আমার দেশঃ আমার স্বাধীনতা, পাক্ষিক পালাবদল)।

বাংলাদেশের শিল্পায়নের তিনটি যুগঃ ব্রিটিশ, পাকিস্তানী ও বাংলাদেশী যুগ। কথা হলো, যদি খোদ শেখ মুজিবকে বা অন্য কোন আওয়ামী লীগ নেতাকে জিজ্ঞেস করা হত, বাংলাদেশের সমগ্র ইতিহাসে কোন আমলে সবচেয়ে বেশী ও সবচেয়ে দ্রুত শিল্পায়ন হয়েছে? যদি এ প্রশ্নও করা হত, কোন আমলে পূর্ব বাংলায় সবচেয়ে বেশী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? সেটি বাংলাদেশী বা ব্রিটিশ আমলে হয়েছে -এ কথা বললে তাঁকে কি কেউ মানসিক দিক দিয়ে সুস্থ বলতো? বাংলার বুকে দুর্ভিক্ষ এসেছে যেমন ব্রিটিশ আমলে, তেমনি বাংলাদেশী আমলেও। এবং দুর্ভিক্ষ আসেনি একমাত্র পাকিস্তান আমলে। অথচ আওয়ামী লীগ মহলটি বাংলাদেশের এ যুগটিকেই চিত্রিত করছে পাঞ্জাবীদের ঔপনিবেশিক শাসনামল রূপে! আখ্যায়ীত করেছে বাংলাদেশের শশ্মান কাল রূপে।

গ্রন্থপঞ্জি

ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন।একাত্তরের স্মৃতি,ঢাকা:নতুন সফর প্রকাশনী,১৯৯৩।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *