অধ্যায় নয়: আত্মবিনাশী ইতিহাস প্রকল্প
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on December 29, 2018
- ই-বুকস
- No Comments.
বেঁচে আছে যুদ্ধ
একাত্তরের যুদ্ধ বহু দশক পূর্বে শেষ হলেও এখনো সেটি বেঁচে আছে। সেটি যেমন দেশের ইতিহাসের বইয়ে, তেমনি বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও চেতনা রাজ্যে। দেশ জুড়ে আজও তাই সংঘাতময় যুদ্ধাবস্থা। ইতিহাস রচনার নামে ইতিহাসের বইয়ে প্রতিনিয়ত বিস্ফোরক ঢালা হচ্ছে। সেটি যেমন মিথ্যাচারের, তেমনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার। ফলে বাংলাদেশে অতি দুঃসাধ্য বিষয়টি হলো রাজনীতিতে শান্তি ও সম্প্রীতির অবস্থা ফিরিয়ে আনা। আরো অসম্ভব হলো, একাত্তরে কি ঘটেছিল তার সঠিক বিবরণটি জানা। ৯ মাসের যুদ্ধে সঠিক কত জন মারা গেল; এবং তারা কোথায়, কীভাবে এবং কাদের হাতে প্রাণ হারালো সে হিসাবটি যেমন নাই, তেমনি একাত্তরের মার্চে ইয়াহিয়া-মুজিব-ভূট্টোর বৈঠকে কি আলোচিত হয়েছিল এবং সে বৈঠক কেন ব্যর্থ হলো -সে বিষয়ে সঠিক রেকর্ডও বাংলাদেশের ইতিহাসে নেই। যুদ্ধ শেষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কি পরিমান অস্ত্রশস্ত্র অব্যবহৃত ছিল এবং সেগুলো কোথায় গেল -সে বিবরণও কোথাও লিপিবদ্ধ করা হয় নাই। বলা হয়, বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে তারা নিজ শক্তি বলে দেশের কোন কোন জেলাগুলি এবং কোন কোন উপজেলাগুলি স্বাধীন করেছিল এবং সেটি কোন কোন তারিখে -সে বিষয়েও কোন তথ্য নেই। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুক্তিবাহিনী নিজ শক্তিতে পাকিস্তান বাহিনীকে পরাজিত করলে ভারতীয়দের কাছে বাংলাদেশীদের কেন এতো নতজানু দায়বদ্ধতা? সে দায়বদ্ধতা পূরণ করতে বাংলাদেশকে কেন ভারতকে করিডোর দিতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাগণ দেশ স্বাধীন করলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভূমিকাটি কি ছিল? কি পরিমান সম্পদ, যানবাহন ও অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশ থেকে লুণ্ঠন করে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়-এসব মোটা দাগের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বাংলাদেশের ইতিহাসে নেই। ইতিহাসের নামে যা চর্চা হয় -তার বেশীর ভাগই গুজব বা বানায়োট কাহিনী নির্ভর। সেটিও দেশের ভারতসেবী পক্ষের রাজনৈতিক স্বার্থে। সেটি যেমন যুদ্ধে তিরিশ নিহত হওয়ার কাহিনী। তেমনি ২৫শে মার্চ এক রাতে ঢাকায় ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু কাহিনী। কাদের সিদ্দিকীর দাবি ২৫ শে মার্চের এক রাতেই পাকিস্তান আর্মি সারা দেশে তিন থেকে পাঁচ লাখ মানুষকে হত্যা করে। (কাদের সিদ্দিকী, ১৯৯৭)। তেমনি দুই বা তিন লাখ নারীর ধর্ষিতা হওয়ার কাহিনী। বস্তুনিষ্ঠ ও বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এগুলি হলো ব্যর্থতার দলিল। একাত্তরের ইতিহাসে যা কিছু বলা হয়েছে বা লেখা হয়েছে -তা আজ ও তাই প্রশ্নবিদ্ধ।
বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস রচনার কাজটি প্রতিযুগে এবং প্রতিদেশেই অতি বিজ্ঞ, নিরপেক্ষ ও আপোষহীন তথ্য অনুসন্ধানকারিদের কাজ। রাজনৈতিক দলের সমর্থকগণ ইতিহাস রচনায় নামলে কল্যাণের চেয়ে মহাকল্যাণটি ঘটে। ইতিহাস তখন কলুষিত হয় এবং বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। একাত্তরের যুদ্ধ বা ঘটনাবলির উপর যারা বই লিখেছেন তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকইপ্রকৃত সত্যকে তুলে ধরার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেছেন। সে সুযোগ স্বৈরাচারী শাসনামলে থাকে না। তারা বরং খেটেছে একাত্তর নিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের পছন্দসই একটি বিবরণকে তুলে ধরতে। কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণার অংশরূপে বা নিজ উদ্যোগে একাত্তর নিয়ে গবেষণা বা লেখালেখি করেছেন বাংলাদেশে সে ঘটনাটি বিরল। ইতিহাস লেখার কাজে অনেককে লাগানো হয়েছিল নিছক সরকারি প্রজেক্টের সদস্য রূপে। তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বটি বস্তুনিষ্ঠ ভাবে সত্যকে তুলে ধরা ছিল না। বরং সরকারি কর্মচারি ও রাজসভার কবির ন্যায় তাদেরও কাজ হয়ে দাঁড়ায়, সরকারি দলের নেতাদের খুশি করতে প্রকৃত ঘটনার উপর ইচ্ছামত মিথ্যার রং চং লাগিয়ে দেয়া।
একাত্তর থেকে ১৯৭৫ সাল অবধি বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণ এবং একাত্তর নিয়ে লেখালেখির ক্ষেত্রটি পুরাপুরি দখলে ছিল ভারতসেবী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের। শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আসার পর সাড়ে চার দশক পরও বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণ এখন সে দখলদারি থেকে মুক্ত হয়নি। শেখ মুজিবের একদলীয় বাকশালী শাসনামলে জনগণের বাকস্বাধীনতাকে কেড়ে নেয়া হয়। স্বৈরাচারী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয় শুধু কথা বলার উপর নয়, লেখনির উপরও। শুধু রাজনীতিতে নয়, ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্থান করে নেয়ার বাতিকও মুজিবের মাঝে ছিল অতি প্রগাঢ় ও অপ্রতিরোধ্য। তার আমলে সরকারি লেখকদের দৃষ্টিতে শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগের কোন দোষই ধরা পড়েনি। শেখ মুজিব যে গণতন্ত্র কবরে পাঠিয়ে একদলীয় স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করলেন, বাকস্বাধীনতা রহিত করে সকল বিরোধী পত্রিকা বন্ধ করলেন, ভারতীয় বাহিনীর অবাধ লুটপাটের অনুমতি দিলেন, দুর্ভিক্ষ ডেকে এনে বহু লক্ষ মানুষের মৃত্যু ডেকে আনলেন -সে বর্ণনাও তাদের রচিত ইতিহাসে নেই। কারণ সেটি হলে তো শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগের কুখ্যাতি হয়। এবং কুখ্যাতি হয় তার রাজনৈতিক অভিভাবক ভারতের। তাতে প্রকাশ পায় মুজিবের নিজ অযোগ্যতার। যে কোন স্বৈরাচারী শাসকের কাছে অতি অসহ্য হলো তার নিজ অযোগ্যতা ও দুর্বৃত্তির প্রচার। ফলে শেখ মুজিবের স্বৈরাচারী শাসনামলে সেটির প্রকাশ অসম্ভব ছিল। মুজিব-বিরোধী যে কোন মতামতের প্রকাশ গণ্য হয়েছে শাস্তিযোগ্য অপরাধ রূপে। ফলে বাংলাদেশের ইতিহাসের বইয়ে মুজিবামলের ভয়ানক দুর্ভিক্ষের কোন বিবরণ নেই। লুণ্ঠন, সন্ত্রাস, দূর্নীতি ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার ইতিহাসও নেই। স্বৈরাচারী শাসকদের ন্যায় মুজিব এবং তার অনুসারিগণও চেয়েছে নিরঙ্কুশ চাটুকারিতা; নিন্দাবাক্য বা সমালোচনা নয়। ফ্যাসিবাদী রাজনীতিতে এরূপ সমালোচনা ও নিন্দার সুযোগ থাকে না। তাদের কথা, ইতিহাসের বইয়ে সর্বপ্রকার নিন্দাবাক্য ও কুৎসিত ভাষা তো ব্যবহৃত হবে মুজিব-বিরোধীদের বদনাম বাড়াতে। স্বৈরাচারীদের কাছে কদর তো পক্ষপাতদুষ্ট দরবারি চাটুকারদের; এবং অসহ্য হলো নিরপেক্ষ ও সত্যনিষ্ঠ ইতিহাসবিদগণ। এরূপ দরবারি চাটুকারদের হাতে ইতিহাসের নামে হাজার হাজার পৃষ্ঠা লেখা হলেও একাত্তরের ইতিহাসের বইয়ে সমৃদ্ধি আসেনি। বরং বেড়েছে মিথ্যাদূষণ। ইতিহাসের বইয়ে মূল উপাদান তো ঘটনার সত্য বিবরণ ও তার বিশ্লেষণে বুদ্ধিবৃত্তির নিরপেক্ষ প্রয়োগ। সেটি না হলে কি ইতিহাসের গ্রন্থ রূপে স্বীকৃতি মেলে?
ইতিহাসের মূল্যায়নটি প্রত্যেকের কাছেই ভিন্ন ভিন্ন হয়। কারণ,এখানে কাজ করে ব্যক্তির নিজস্ব দর্শন, মূল্যবোধ ও চিন্তার মডেল। তাই একই ঘটনার রায় ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে ভিন্নতর হয়। জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে আনবিক বোমা নিক্ষেপ মার্কিনীদের কাছে শুধু ন্যায্যই মনে হয়নি, উৎসবযোগ্যও গণ্য হয়েছে। ইরাকে ইঙ্গো-মার্কিন যৌথ আগ্রাসন, হত্যা ও বোমাবর্ষণ ইরাকীদের কাছে যত নিষ্ঠুরই হোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট, ব্রিটেন ও তাদের মিত্রদের কাছে গণ্য হয়েছে মহৎ কর্ম রূপে। এরূপ গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে তারা সভ্যতা ও গণতন্ত্রের বিজয় দেখেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ও সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের এ নিয়ে কত অহংকার! এমন দুটি ভিন্ন ধরনের রায় এসেছে একাত্তরের লড়াই নিয়েও। একাত্তরে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিপরিত মুখী চেতনা কাজ করছিল। একটি ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনা। সে চেতনায় পাকিস্তান ভাঙ্গা, পাকিস্তানপন্থী এবং অবাঙালীদের হত্যা করা ও তাদের ঘরবাড়ী ও দোকানপাট দখলে নেয়া ন্যায্য কর্ম গণ্য হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ অবাঙালীকে তাদেরকে বাড়ী থেকে উচ্ছেদ করে বস্তিতে পাঠিয়ে দেয়াও কোন রূপ অন্যায় বা অসভ্যতা মনে হয়নি। যদিও যে কোন দেশের সভ্য ও বিবেকমান মানুষের কাছে এমন হত্যা, এমন উচ্ছেদ ও এমন জবরদখল অতি জঘন্য অপরাধ। আন্তর্জাতিক আইনে এরূপ কর্ম যুদ্ধাপরাধ। অথচ বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের কাছে তা অতিশয় বীরত্বের কাজ মনে হয়েছে। সে বীরত্বের পুরস্কারস্বরূপ এসব লুণ্ঠিত সম্পত্তির অবৈধ দখলকারিদেরকে বাংলাদেশের সরকার নিজ হাতে মালিকানার দলিল পৌঁছে দিয়েছে। সভ্য দেশে পশু নির্যাতন হলে সেটিও খবর হয়। কিন্তু বিহারীর উপর যে নির্যাতন হয়েছে সে বিবরণ ইতিহাসে স্থান পায়নি। অবাঙালীগণ যে ভারতীয় মুসলিম নিধন থেকে বাচঁতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল এবং বাঙালীদের হাতে গৃহহীন হয়েছে এবং হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে একাত্তরের ইতিহাসে এরূপ যুদ্ধাপরাধের সামান্যতম উল্লেখও নেই।
প্রপাগান্ডার হাতিয়ার
বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের রচিত একাত্তরের ইতিহাসের বইগুলো যেমন পক্ষপাতদুষ্ট, তেমনি প্রপাগান্ডার হাতিয়ার। এসব বইয়ের লক্ষ্য ছাত্র-ছাত্রীদের জ্ঞানদান নয়। বরং যারা হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও সীমাহীন দুর্নীতির নায়ক এবং ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের জনক -তাদের চিত্রিত করা হয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে। উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনায় ব্যক্তির বিচারবোধ যুগে যুগে এভাবেই বিকৃত হয়েছে। জার্মান জাতি অশিক্ষিত ছিল না। বরং হিটলারের আমলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমগ্র বিশ্বে তারাই সবার চেয়ে অগ্রসর ছিল। কিন্তু হিটলারের ন্যায় মানব ইতিহাসের এই বর্বর ব্যক্তিটিও তাদের কাছে নেতা রূপে গণ্য হয়েছে। নির্বাচনে তার দল বিজয়ী হয়েছে। বহুলাখ ইহুদীকে গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে হত্যা করাটিও তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়েছে।জার্মানীর নগরে বন্দরে এমন নৃশংস বর্বরতার বিরুদ্ধে জনগণ প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমেছে -সে নজির নেই। জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিবেকের মৃত্যু যে কতটা মহামারী আকারে ঘটে -এ হলো তার প্রমাণ। একাত্তরে সে মড়ক লেগেছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের বিবেকেও। বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনায় বাঙালী হওয়া এবং অন্য যারা বাঙালী তারা পৌত্তলিক, নাস্তিক, খুনি বা ধর্ষণকারি হোক বা কম্যুউনিস্ট হোক -তাদের সাথে বন্ধন গড়াটি গুরুত্ব পায়; এবং ঘৃনীত হয় ইসলামী হওয়া। কারণ ইসলাম ব্যক্তিকে তো ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠাকে বাধ্যতামূলক করে। কিন্তু সেটি হলে তো জাতীয়তাবাদ বাঁচে না। বাঁচেনা তাদের ক্ষমতার রাজনীতিও। এজন্যই ইসলামের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদীদের এতো দুশমনি।
পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাসের গ্রন্থে বাঙালী যুবকগণ কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা হলো এবং কিভাবে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিল –সে বিষয়টি বিষদ ভাবে আলোচিত হয়েছে। ভারতের নিমক খাওয়া ও ভারত থেকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নেয়া জীবনের বিশাল অর্জন রূপে চিত্রিত হয়েছে। কিন্তু হাজার হাজার বাঙালী সন্তান কেন ভারতে না গিয়ে বরং পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিরোধীতা করল, এবং কেন তারা রাজাকার হয়ে পাকিস্তানের একতা রক্ষায় সচেষ্ট হলো, এমনকি প্রাণও দিল –তার তাত্ত্বিক বা দর্শনগত বিশ্লেষণ এ ইতিহাসে নেই। তাদের নিয়েত ও চেতনার গভীরে নজর দেয়া হয়নি। কেনই বা দেশের প্রতিটি ইসলাম দল এবং প্রায় প্রতিটি ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও আলেম পাকিস্তান ভাঙ্গার বিরোধীতা করল -তারও কোন বস্তুনিষ্ঠ ও বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাখা এ ইতিহাসে নেই। বরং নিজেদের মনগড়া একটি কুৎসিত গালিগালাজ ও মটিভ ইসলামপন্থীদের গায়ে এঁটে দিয়েছে। তাদেরকে চিত্রিত করা হয়েছে পাকিস্তানের দালাল ও অপরাধী রূপে। লক্ষ্য, স্রেফ চরিত্র হনন। এ ইতিহাসের লেখকগণ তাদেরকে চিত্রিত করেছে খুনি, পাঞ্জাবী সৈনিকদের নারী সরবরাহকারি রূপে। এ অভিযোগ থেকে এমনকি ইসলামী দলসমূহের প্রবীণ নেতা-কর্মী ও ধর্মপ্রাণ বৃদ্ধ আলেমদেরও রেহাই দেয়া হয়নি। অথচ তাদের দাবির স্বপক্ষে একটি প্রমাণও হাজির করতে পারিনি।
লুকানো হয়েছে অপরাধ
ইতিহাসের বইয়ে শুধু একটি জনগোষ্ঠীর কর্ম বা অর্জনগুলি তুলে ধরলে চলে না; তাদের ভয়ানক রোগগুলিও তুলে ধরতে হয়। বরং চরিত্রের রোগগুলি তুলে ধরার গুরুত্ব আরো বেশী। কারণ স্বাস্থের কারণে কারো মৃত্যু ঘটে না, মৃত্যু ঘটে তো প্রানবিনাশী রোগের কারণে। চিকিৎসা শাস্ত্রে তাই বিশাল বিশাল বই লেখা হয়েছে মানব দেহের বিচিত্র রোগ সমূহের বিবরণ ও চিকিৎসার বর্ণনা দিতে; স্বাস্থের বর্ণনা দিতে নয়। সেটি সত্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক রোগগুলির ব্যাপারেও। ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের বইয়ে সে রোগগুলি বিষদ ভাবে আলোচিত না হলে ভবিষ্যতে তা থেকে বাঁচার পথই বা কীরূপে আবিস্কৃত হবে? বাংলাদেশে আজ যে একদলীয় শাসন, বিদেশী দখলদারি ও স্বৈরাচার –তা তো হঠাৎ সৃষ্টি হয়নি। বরং সেটি ঘটেছে দিন দিন বেড়ে উঠা সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক ব্যাধিগুলোর কারণে –যার অধিকাংশেরই আলামত প্রকাশ পেয়েছিল উনিশ শ’ একাত্তরে। কিন্তু একাত্তরে প্রকাশ পাওয়া সে ভয়ানক রোগগুলি বাংলাদেশের ইতিহাসে চিহ্নিত হয়নি, ফলে চিকিৎসাও হয়নি। বরং কীর্তন গাওয়া হয়েছে স্বৈরাচারী মুজিব ও তার ভ্রষ্ট রাজনীতির। তাতে দেশের উপর পুনরায় বাকশালী স্বৈরাচার চেপে বসার পথ উম্মুক্ত হয় -তার প্রমাণ তো ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সালের বাংলাদেশ। দেহে ক্যান্সার লুকিয়ে রেখে লাভ হয় না,তাতে বরং ত্বরিৎ মৃত্যু ঘটে। তাই ইতিহাসের বইয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মানবতাবিনাশী রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও দর্শনগত রোগের বিবরণগুলো নিখুঁত ভাবে তুলে ধরা। এবং স্কুল-কলেজে সেগুলী পাঠ্য করা। নইলে মিথ্যামুক্তি ঘটে না;একই অপরাধ তখন বার বার ঘটে। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের বইয়ে সেটি হয়নি; বরং বাঙালীর হাতে একাত্তরে ঘটে যাওয়া বহু ভয়ানক অপরাধ লুকানো হয়েছে। তালাশ করা হয়েছে স্রেফ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও বিহারীদের দোষগুলো। অন্যের দেহের ক্যান্সার ও ক্ষতগুলো নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কি? বিশেষ করে নিজ দেহের ক্যান্সারটি যখন ভয়ানক।এ বিষয়টি একাত্তরের ইতিহাসে গুরুত্ব না পাওয়ায় এটি এখন আত্মবিনাশের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের মাটিতে একাত্তরে এমন বহু অমানবিক নৃশংস ঘটনা ঘটেছে -যা পূর্বে কখনোই ঘটেনি। সেটি যেমন অবাঙালীদের পক্ষ থেকে তেমনি বাঙালীদের হাতে। এমন ঘটনাও ঘটেছে যা ইসলামী চেতনা ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে। কোরআন-হাদীসের শিক্ষা থেকে সেগুলো ছিল বহু দূরে। একজন মুসলমান কি তা ভাবতে পারে? আজ থেকে ১৩ শত বছর আগে আরব, কুর্দ, তুর্ক ও ইরানী অধ্যুষিত মুসলিম রাষ্ট্রের মানচিত্র ভাঙ্গার কাজে কেউ যদি একাত্তরের বাঙালীদের ন্যায় মুর্তিপূজারীদের সাথে কোয়ালিশন গড়তো -তবে তাদেরকে কি বলা হত? মুসলমানদের রাষ্ট্র ভাঙ্গার কাজ যুগে যুগে যে হয়নি -তা নয়। তবে কোন কালেই সে কাজটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের পক্ষ থেকে হয়নি। মুসলমানগণ বরং নানা ভাষাভাষি ও নানা এলাকার মানুষের মাঝে মিলন গড়েছে –যেমনি ১৯৪৭ সালে ভারতের বুকে হয়েছিল। এটিই ইসলামের ঐতিহ্য। বিভক্তির পথ সব সময়ই হারাম পথ রূপে বিবেচিত হয়েছে। তাই অতীতে মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিভক্তি গড়েছে ইসলামের শত্রুগণ; এবং তাদের সহায়তা দিয়েছে ভণ্ড মুসলিমগণ। সেসব চিহ্নিত শত্রুদের সাথে মৈত্রী গড়েছে জাতীয়তাবাদী ও ট্রাইবাল রাজনীতির অনুসারিগণ। মুসলিম ভূগোল সর্বশেষে টুকরো টুকরো হয়েছে ব্রিটিশ ঔপনেবিশিকদের হাতে। আরব বিশ্বকে তারাই বিশেরও বেশী টুকরায় ভেঙ্গেছে। মুসলিম দেশ কাফেরদের হাতে অধিকৃত হওয়ার এটিই হলো সবচেয়ে বড় কুফল। ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে তারা অনেক দূরে নিয়ে যায়। অতিশয় হারাম কাজকেও তারা সহজ করে দেয়। মুসলিম ভূমিতে ব্যাভিচারও তখন বাণিজ্য রূপে প্রতিষ্ঠা পায়। প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সূদ ও কুফরী আইন। কাফেরদের অস্ত্র নিয়ে ভণ্ড মুসলিমগণ অন্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে ও তাদের হত্যা করেছে –এমন গর্হিত কর্মটি সচারচার কোন মুসলিম দেশে ঘটে না। সেটি একমাত্র তখনই ঘটে যখন কোন মুসলিম ভূমি কাফেরদের হাতে অধিকৃত হয়। তাই কাফেরদের অধিকৃতির বিরুদ্ধে যে কোন যুদ্ধই পবিত্র জিহাদ। তবে উনিশ শ’ একাত্তরে বাংলাদেশের বুকে যেটি ঘটেছে -সেটি কোন মুসলিম দেশে ঘটে না। সেটি হলো, পৌত্তলিক কাফেরদের হাতে অধিকৃত হওয়ার আগেই ইসলামচ্যুৎ বাঙালী মুসলিমগণ তাদের অস্ত্র নিয়ে মুসলিম হত্যা ও মুসলিম দেশের বিনাশে নেমেছে। সেটি ঘটেছে তাদের হাতে যাদের চেতনার ভূমি বহু পূর্বেই অধিকৃত হয়েছিল সেক্যুলারিজম, ন্যাশনালিজম, সোসালিজম ও কম্যুউনিজমের ন্যায় ইসলাম বিরোধী ধ্যান-ধারণায়।
মুসলিম ভাতৃত্বের বিলুপ্তি
রাষ্ট্র দূরে থাক, ইসলাম কোন মুসলমানের ঘর ভাঙতেও অনুমতি দেয় না। মুসলমান হওয়ার অর্থ শুধু মহান আল্লাহতায়ালার উপর ঈমান ও তাঁর ইবাদত নয়; ঈমান ও ইবাদত পালনের সাথে অন্য ঈমানদারকে ভাই রূপেও গণ্য করতে হয়। অন্য মুসলমান –তা যে ভাষা, যে বর্ণ বা যে অঞ্চলেরই হোক, সে যে তার প্রাণপ্রিয় ভাই।সেটি তার পিতা, নেতা বা পীরের কথা নয়; সে ঘোষণাটি এসেছে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “মুসলিম মাত্রই পরস্পরে ভাই। অতঃপর নিজ ভাইদের মাঝে পরস্পরে কল্যাণ কর। এবং আল্লাহর প্রতি নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে যত্মবান হও -যাতে তোমরা তাঁর রহমত পেতে পার।”–(সুরা হুজরাত, আয়াত ১০)। প্রতিটি মুসলিমের উপর ঈমানী দায়ভার তাই মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া ভাতৃত্বের পরিচয়ের প্রতি সম্মান দেখানো। সেটি না হলে প্রচণ্ড অসম্মান ও অবাধ্যতা হয় মহান আল্লাহতায়ালার পবিত্র হুকুমের বিরুদ্ধে। ঈমানদারগণ কি তাই নিজ ভাইদের মাঝে বিভেদের দেয়াল গড়তে পারে? ভিন্নভাষী প্রিয় ভাইকে দেখা মাত্র একজন সুস্থ ব্যক্তির প্রতিক্রিয়াটি কি এরূপ হবে,সে মুখ ফিরিয়ে নিবে? ভিন্ দেশী ও ভিন্ ভাষী ভাইকে মারতে উদ্যত হবে? তার সম্পদ কেড়ে নিবে এবং তাকে তার বসত ঘর থেকে নামিয়ে সে ঘরটি নিজের দখল নিবে? অথচ একাত্তরে অবাঙালীদের সাথে বাঙালী মুসলিমগণ তো সেটিই করেছে! বাঙালী মুসলিমের এ এক বিশাল ব্যর্থতা। বাংলার মাটিতে মুসলিম ভাতৃত্বের এ এক বিষাদময় বিলুপ্তি। এমন ব্যর্থতা নিয়ে বাঙালী মুসলিমগণ মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে মুসলিম রূপে মুখ দেখাবে কি করে? অথচ একাত্তরের সে ব্যর্থতা নিয়ে একাত্তরের ইতিহাসে সামান্যতম উল্লেখ নেই।কোন রূপ ক্ষোভও নাই। এবং সে চারিত্রিক রোগের কোন চিকিৎসাও হয়নি। বরং গর্ব বেড়েছে জাতীয়তাবাদের রোগ নিয়ে!
ঈমানের লক্ষণঃ ভিন্ দেশী, ভিন্ বর্ণ ও ভিন্ ভাষী ভাইকে দেখে ঈমানদারের মুখই শুধু হাসবে না, তার আত্মাও আনন্দে আন্দোলিত হবে। সে তার কল্যাণে সাধ্যমত সাহায্য করবে। মহান আল্লাহতায়ালার উচ্ছা পালনে মু’মিন ব্যক্তি তো প্রতি দিন ও প্রতি মুহুর্তে এরূপ ব্যাকুল থাকবে। অন্তরে যে ঈমান বেঁচে আছে সেটির প্রমাণ তো আপন ভাইয়ের কল্যাণে এরূপ ব্যস্ততা। মুসলিম হওয়ার অর্থ শুধু নামাযী বা রোযাদার হওয়া নয়; নিজ ভাষা,নিজ গোত্র ও নিজ ভূগোলের সীমানা ডিঙ্গিয়ে অন্য ভাষা ও অন্য ভূগোলের মুসলমানের সাথে একাত্ব হওয়াও। এটিই ইসলামের বিশ্বভাতৃত্ব তথা প্যান-ইসলামীজম। মহান আল্লাহতায়ালার উপর বিশ্বাসী হওয়ার অর্থ, ইসলামের এ বিশ্বভাতৃত্বের চেতনায় সমৃদ্ধ হওয়াও। ব্যক্তির কর্ম, চেতনা ও রাজনীতিতে সেরূপ ভাতৃত্বের প্রকাশ না ঘটলে নিশ্চিত বুঝতে হবে তার ঈমানের ভাণ্ডারে প্রচণ্ড ফাঁকিবাজি ও শূন্যতা রয়ে গেছে। প্রাথমিক যুগের মুসলিমগণ এমন ভাতৃত্বের চেতনা নিয়েই ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার নামে গড়ে উঠা বিভেদের দেয়ালগুলো ভেঙ্গেছিলেন। মদিনার আউস ও খাজরাজ গোত্রদ্বয় শত শত বছর ব্যাপী পরস্পর যুদ্ধ করেছে। মুসলমান হওয়ার সাথে সাথে সে আত্মঘাতি যুদ্ধ থেমে যায়, গড়ে ওঠে অটুট ভ্রাতৃত্ব। তাঁরা প্রাণপ্রিয় ভাই রূপে গ্রহণ করেছিল মক্কার মোহাজিরদেরকে। নিজের একমাত্র ঘরখানিও ঘরহীন মোহাজির ভাইদের সাথে ভাগ করে নিয়েছিলেন। এটিই তোঈমানদারী। ১৯৪৭ সালে এমন এক ইসলামী চেতনা ও ঈমানদারী কাজ করেছিল বাঙালী মুসলিমদের মাঝেও। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিমগণ সেদিন ঢাকার মীরপুর, মোহাম্মদপুরের ন্যায় প্রায় প্রতি জেলায় বিশাল বিশাল এলাকা ছেড়ে দিয়েছিল হিন্দুস্থান থেকে আগত তাদের নির্যাতিত মোহাজির ভাইদের বাসস্থান নির্মাণে। কিন্তু একাত্তরে সে ইসলামী চেতনা মারা পড়ে সেক্যুলারিজম ও জাতিয়তাবাদের সংক্রামক ভাইরাসে। জীবাণূ দেহে ঢুকলে সুঠাম দেহও মৃত্যুর কোলে ঢুলে পড়ে। তেমনি জাতীয়তাবাদী চেতনার বীজ মগজে ঢুকায় মারা যায় ইসলামের বিশ্বভাতৃত্বের চেতনা। কিন্তু একাত্তরের ইতিহাসে ঈমানধ্বংসী সে মহামারির সামান্যতম বিবরণও নেই। বাংলাদেশের ইতিহাস বই পড়লে মনেই হয় না বাংলাদেশের বুকে এতো বড় বীভৎস কাণ্ডটি ঘটেছে। অবাঙালী মুসলিমদের মাঝেও বহু দোষত্রুটি ছিল।দুর্বৃত্ত মানুষের সংখ্যা কি বাঙালীদের মাঝে কম? সে জন্য কি একটি বিশেষ ভাষার মানুষদের বিরুদ্ধে নির্মূলে বা অত্যাচারে নামতে হবে?
মহান আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহর বর্ণনা দিয়েছেন সীসাঢালা দেয়াল রূপে -যারা দেয়ালের সে অটুট ঐক্য নিয়ে জিহাদে অংশ নেয়। কোরআনের ভাষায় সে দেয়ালটি হলো “বুনিয়ানুম মারসুস”। নবীজীর (সাঃ) যুগে এমন কোন সাহাবী ছিলেন না যারা সীসাঢালা দেয়ালের ন্যায় ঐক্য নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার পথে জিহাদে নিজ শ্রম, নিজ অর্থ ও নিজ মেধার বিনিয়োগ করেননি। অধিকাংশ সাহাবী এ কাজে শহীদ হয়েছেন। যে বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা মুসলিম উম্মাহর দেয়ালে ফাটল ধরায় -ইসলামে সেটি হারাম। যার মাঝে পবিত্র কোরআনের জ্ঞান আছে তার দ্বারা এমন গর্হিত কাজ কি সম্ভব? অনৈক্য ও ভাতৃঘাতি সংঘাত তো ইসলামী চেতনাশূন্য ও কোরআনের জ্ঞানে অজ্ঞদের সংস্কৃতি। ঈমানশূন্য ও ইসলাম থেকে দূরে সরা ব্যক্তিদের দ্বারাই এমন পাপাচার সম্ভব। ইসলাম থেকে দূরে সরার কারণেই ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজটি জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিষ্টদের কাছে উৎসবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ইসলামের পক্ষের শক্তি তা থেকে সযত্নে দূরে থেকেছে। বরং আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল দেশটির হেফাজতে। একাত্তরে ইসলামপন্থীদের ভূমিকার এটিই হলো দার্শনিক ভিত্তি –যা তাদেরকে অন্যান্য বাঙালীদের থেকে পৃথক করে। ইতিহাসের বইয়ে ইসলামপন্থীদের একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে প্রচণ্ড চরিত্রহনন হলেও তাদের জীবনে ইসলামী দর্শনের এ গভীর প্রভাব নিয়ে আলোচনা হয়নি। হয়তো এ ভয়ে, তাতে তাদের নিজ জীবনের ভ্রষ্টতা ও ইসলামের সাথে প্রতারণা সামনে এসে যাবে।
সবাই স্রোতে ভাসেনি
পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির আন্দোলনটি ছিল সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানী বাঙালীর -এটিও আরেক মিথ্যাচার। বরং সত্য হলো, সবাই সেদিন বাঙালী জাতীয়তাবাদের স্রোতে ভেসে যায়নি। লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজেদের দৃড় ইসলামী বিশ্বাস নিয়ে বরং স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে। তাদের কারণেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কোন জেলা দূরে থাক,কোন থানাও মুক্তি বাহিনী দখলে নিতে পারেনি। দেশ দখলে যায় একমাত্র ভারতের বিশাল স্থল, বিমান ও নৌ বাহিনীর দ্বারা পুরা দেশ অধিকৃত হওয়ার পর। অথচ একাত্তরের ইতিহাসে সে বিবরণও নাই। বরং ইসলামী বিশ্বাস নিয়ে দাঁড়ানোটি চিত্রিত হয়েছে মানবতা বিরোধী অপরাধ রূপে। অথচ মুসলমান হওয়ার মূল দায়বদ্ধতাটি হলো, পবিত্র কোরআনে বর্ণীত মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম পালন –এমন কি যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়ের বিরোধীও হয়। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা মহান নবী করীম (সাঃ)কে সতর্ক করে দিয়েছেন এই বলে,“ওয়া ইন তু’তি আকছারা মান ফিল আরদে ইউদিল্লুকা আন সাবিলিল্লাহ” অর্থঃ “এবং আপনি যদি এ জমিনে বসবাসকারি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের অনুসরণ করেন তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে বিভ্রান্তির পথে নিয়ে যাবে।” তাই জনস্রোতে ভাসাটি আদৌ ঈমানদারী নয়; এটি পথভ্রষ্টতার পথ। ঈমানদারকে তো প্রতি মুহুর্তে চলতে সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে; সেটি একাকী হলেও।একাত্তরে তাই দেশের ইসলামপন্থীদের মাঝে ভারতে যাওয়া ও মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়ার ঢল সৃষ্টি হয়নি। বরং তাদের মাঝে রাজাকার সৃষ্টি হয়েছে।
যারা সেক্যুলার ও ইসলামী চেতনাশূন্য তাদের কথা ‘জনগণ কখনও ভুল করে না’। এটি স্রেফ মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি দায়শূন্য ও জবাবদেহীতার ভয়শূণ্য গণমুখীতার কথা; আদৌ ঈমানদারীর কথা নয়। একাত্তরে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠের পথটি অনুসরণ করেনি তাদেরকে এরূপ ঈমানশূণ্যগণই বিশ্বাসঘাতক বলে চিত্রিত করে। তাদের এরূপ দাবী যে কতটা মিথ্যা ও কোরআন-বিরোধী সেটি কি পবিত্র কোরআনের উপরুক্ত আয়াতটি শোনার পরও বুঝতে বাঁকী থাকে? সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যে সিদ্ধান্ত নিতে কত বড় বড় বিশাল ভুল করে বাংলাদেশের জনগণ সেটি যেমন ১৯৭০ ও ১৯৭১’য়ে প্রমাণ করেছে, তারপরও বহুবার প্রমাণ করেছে। গণতন্ত্র হত্যাকারি বাকশালী মুজিব কে কারা নির্বাচিত হয়েছিল? বিগত সংসদ নির্বাচনগুলিতে এরশাদের ন্যায় সাজাপ্রাপ্ত দুর্বৃত্তকে কারা বিপুল ভোটেবিজয়ী করেছে? সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই কি হিটলার, জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়ারের ন্যায় নৃশংস হত্যাকারিদের নির্বাচিত করেনি? হযরত মুসা (আঃ)’য়ের নির্মূলে এবং ফিরাউনের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই কি অস্ত্র ধরেনি?
সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন ইসলামের নবী হযরত মহাম্মদ (সাঃ)ও। মক্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রচণ্ড বিরোধীতা ও বয়কটের কারণেই নবীজী (সাঃ) কে মাতৃভূমি ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করতে হয়েছিল। মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো, কচুরিপানা বা খড়কুটোর ন্যায় গণ-স্রোতে ভেসে যাওয়া থেকে বাঁচা। ইসলাম ও মুসলিমের জন্য যা কিছূ কল্যাণকর, শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও সেটির উপর অটল থাকাই হলো ঈমানদারী। প্রশ্ন হলো, দুনিয়ার সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিনাশে কি কোন কল্যাণ থাকতে পারে? এতে ফায়দা তো ইসলামের শত্রুপক্ষের। তাই একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গার মধ্যে অথ অকল্যাণই দেখেছে ইসলামী চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তিরা। ফলে প্রচণ্ড বিরোধীতা করেছে পাকিস্তান ভাঙ্গার। তাদেরকে সেদিন জীবনের প্রচণ্ড ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। পাকিস্তানের পক্ষ নেয়ার অর্থ ছিল, ভারতীয় এজেন্টদের হামলার মুখে পড়া। ঘরবাড়ি ও দোকান-পাট লুট হবে এবং নিজেদেরও নিহত হতে হবে– সে সম্ভাবনাও ছিল। সেটি প্রমাণিত হয়েছে যুদ্ধচলাকালীন ৯ মাসে এবং ১৯৭১ য়ের ১৬ ডিসেম্বরের পর। তারপরও তারা ঝুঁকি নিয়েছে। কথা হলো, এমন চেতনাসমৃদ্ধ আত্মত্যাগী মানুষদেরকে কি দালাল ও নারী সরবরাহকারি বলা যায়? অথচ দেশের সেক্যুলারিস্টগণ সেটিই বলে আসছে। অথচ একাত্তরের পূর্বে তাদের বিরুদ্ধে এরূপ কদর্য চরিত্রের অভিযোগ ছিল না। অবশ্য এসব কথা যে তারা বিবেকের তাড়নায় বলছে তা নয়, বলছে নিজেদের রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণে। রাজনীতিতে বেঁচে থাকার স্বার্থে ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে এমন মিথ্যাচারকে তারা অপরিহার্য মনে করে।
পশ্চিমা ওরিয়েন্টালিস্ট তথা প্রাচ্যবিদগণ এককালে প্রচুর বই লিখেছে ইরানীদের এ কথা বুঝাতে যে,আরবরা তাদের উপর অকথ্য নির্যাতন ও প্রকাণ্ড হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। এদেরই আরেক দল বই লিখেছে আরবদের এ কথা বুঝাতে যে ইরানীরা কতটা বর্ণবাদী, আরববিদ্বেষী ও ষড়যন্ত্রকারি। এভাবে দুই অঞ্চলের দু’টি ভিন্ন ভাষাভাষি মানুষের মাঝে তারা বিভেদকে অতিশয় গভীর ও প্রতিহিংসাপূর্ণ করেছে। এরা আপোষে ভাগাভাগী হয়ে বিবাদমান দুই মুসলিম দলেই খেলেছে। যাতে মুসলিম উম্মাহর মাঝে ভাতৃঘাতী লড়াই স্থায়ী হয় এবং রক্তাত্বও হয়। মুসলিম ভূমিতে ভাতৃঘাতী সংঘাতকে দীর্ঘ ও রক্তাত্ব করতে তারা নিজ অনুগতদের হাতে যেমন অস্ত্র তুলে দিয়েছে, তেমনি প্রশিক্ষণও দিয়েছে। মুসলিমদের ত্রুটি নিয়ে তারা বিস্তর লিখলেও নিজেদের অতিশয় ঘৃণ্য অপরাধগুলি নিয়ে আলোচনা করেনি। তাই তাদের ইতিহাসে নাই সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, শাসন ও দুর্বৃত্তির বিবরণ। আজও লিখিত হচ্ছে না আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিনের ন্যায় বিশ্বের কোণে কোণে তাদের কৃত বীভৎস বর্বরতার কথা। এ নীতিতে আজও তারা অটল। ভারতীয় লেখকগণও একই পথ ধরেছে। তারা বাংলাদেশে অবাঙালী মুসলিমদের শোষক, নির্যাতনকারি ও খুনি রূপে পেশ করছে। অথচ এ কথা লিখছে না, পূর্ব পাকিস্তানে অবাঙালী মুসলিমগণ যত কলকারখানা গড়েছে, বৃটিশগণ ১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনে তার শত ভাগের এক ভাগও গড়েনি। এমনকি পাকিস্তানের ২৩ বছরে খোদ বাঙালী পুঁজিপতিরা তার সিকি ভাগও গড়েনি। অপরদিকে তারা ভারত ও পাকিস্তানের অবাঙালীদেরকে বুঝাচ্ছে বাঙালীরা কতটা কলহপ্রবন, সহিংস ও অবাঙালী-বিদ্বেষী সেটি। ফলে বাংলাদেশের মানুষদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে পারছে না পাকিস্তান ও ভারতের অবাঙালী মুসলিমগণও। একাত্তরের ইতিহাস এভাবে মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিষ ছড়ানোর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এতে বাঙালী মুসলিমের বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে অন্যভাষী মুসলিম ভাইদের থেকে। একাত্তরের ইতিহাসের নাশকতাটি তাই বিশাল। এতে শুধু দেশবাসীর মাঝে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও ঐক্য গড়ার কাজটিই ব্যহত হচ্ছে না, বরং ব্যহত হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর সাথে ভাতৃসুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়টিও। ইসলাম ও মুসলিমের শত্রুপক্ষ তো সেটিই চায়। আর তাদেরই লাঠিয়াল রূপে কাজ করছে বাঙালী জাতীয়তাবাদীগণ।
গ্রন্থপঞ্জি:
কাদের সিদ্দিকী, ১৯৯৭: স্বাধীনতা ‘৭১, অনন্যা, ৩৮/২ বাংলাবাজার, ঢাকা।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018