মুসলিম দেশগুলির বিধ্বস্ত সোশাল রিফাইনারি
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on February 2, 2019
- মুসলিম জাহান
- No Comments.
অপরিহার্য কেন সোশাল রিফাইনারি? –
খনির খাম তেল সরাসরি গাড়ির ফুয়েল ট্যাংকে ঢাললে তাতে গাড়ি চলে না। বরং তাতে বিকল হয় ইঞ্জিন। খনির তেলকে তাই ব্যবহার-উপযোগী করতে হলে ওয়েল রিফাইনারিতে নিয়ে পরিশোধিত করাটি জরুরী। বিষয়টি শত ভাগ সত্য মানব সন্তানের পরিশুদ্ধি ও মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার বেলায়ও। বিষয়টি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, পরিশোধনের সে প্রক্রিয়াকে বলবৎ রাখতেই মহান আল্লাহতায়ালা প্রথম মানবকে স্রেফ মানব রূপে নয়, নবী রূপেও প্রেরণ করেছেন। এবং অব্যাহত রেখেছেন নবী-রাসূল প্রেরণ এবং সে সাথে ফেরেশতা মারফত ওহী প্রেরণ। ইসলামে ইসলামী রাষ্ট্র গড়া এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতির কার্যকর অবকাঠামো গড়ে তোলা এজন্যই এতো জরুরী। নবীজী (সাঃ)র প্রসিদ্ধ হাদীস, প্রতিটি মানব শিশুই জন্ম নেয় মুসলিম রূপে। কিন্তু পরবর্তীতে সে মুসলিম রূপে বেড়ে উঠতে ব্যর্থ হয় পরিবার ও সামাজিক পরিবেশের কারণে। এর কারণ, প্রতিটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অঙ্গণে কাজ করে একটি বিশেষ ধাঁচের শক্তিশালী সোশাল ইঞ্জিনীয়ারিং। কোন শিশুই তা থেকে নিস্তার পায় না। ফলে হিন্দু, খৃষ্টান, শিখ বা বৌদ্ধ ঘরের সন্তান যত মেধাবীই হোক আল্লাহর দ্বীনকে বুঝা এবং সে অনুসারে বেড়ে উঠার সামর্থ্য সে পায় না।
ব্যক্তির চেতনা, চরিত্র, কর্ম ও জ্ঞানের ভূবনে কতটা ভ্যালু এ্যাড হবে এবং সে কোন ধর্ম বা মতবাদ নিয়ে বেড়ে উঠবে সেটি নির্ধারণ করে চলমান পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অঙ্গণে চলমান সোশাল ইঞ্জিনীয়ারিং। সে সোশাল ইঞ্জিনীয়ারিং প্রক্রিয়াটি প্রতিষ্ঠা না পেলে কোন ধর্ম বা মতাদর্শ সমাজে বাঁচে না বা বিজয়ী হয় না। এজন্যই ইসলামের মহান নবীজী (সাঃ)কে শুধু ইসলামের প্রচারই করেননি, বরং ইসলামি রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার এবং ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতিরও প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। বস্তুতঃ এটিই ছিল সে আমলে মুসলিমদের অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্ত বিনিয়োগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত। সে রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠা ও প্রতিরক্ষা দিতে নবীজী (সাঃ)র শতকরা ৭০ ভাগের সাহাবীকে তাদের প্রাণের কোরবানী দিতে হয়েছে। তাদের সে কোরবানীর ফলেই রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার ও মসজিদ-মাদ্রাসা পরিণত হয়েছিল শক্তিশালী সোসাল রিফাইনারিতে। বিশ্বশক্তি রূপে মুসলিমদের উদ্ভব এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার নির্মাণে তাদের যে বিশাল সফলতা জুটেছিল -তার মূলে ছিল নবীজীর (সাঃ)র হাতে প্রতিষ্ঠিত সে সোসাল রিফাইনারিগুলি। সে লক্ষ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ইসলামী শিক্ষা ও ইসলামী রাষ্ট্র। ইসলামী রাষ্ট্রের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যেমন মানব সমাজে থাকতে পারে না। তেমনি শিক্ষাদানের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণি কোন কর্মও থাকতে পারে না। ফলে জীবনের যে দিনটিতে নবীজী (সাঃ) নবীর মর্যাদা পান, সেদিনই সর্বপ্রথম যে হুকুমটি পান সেটি হলো “ইকরা” তথা পড়ার। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের হুকুম পান তার ১১ বছর পর। মক্কার কাফেরগণ ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সুযোগ তাঁকে দেয়নি; কিন্তু সে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দেন মদিনায় হিজরতের প্রথম দিনেই। গড়ে তোলেন মসজিদ। সে মসজিদে তিনি ছিলেন সার্বক্ষণিক শিক্ষক। বিদ্যা শিক্ষা এতটাই গুরুত্ব পেয়েছিল যে, বদরের যুদ্ধের হত্যাযোগ্য যুদ্ধাপরাধীদের এ শর্তে মুক্তি দিয়েছিলেন যে তারা মুসলিমদের বিদ্যা শিক্ষা দিবে।
সমাজ ও রাষ্ট্রের বুকে মানবের চিন্তা-চেতনার পরিশুদ্ধির একটি সফল ও শক্তিশালি অবকাঠামো না থাকলে শুধু মুসলিমদের সন্তানেরাই নয়, নবী-রাসূলদের সন্তানও ব্যর্থ হয় মুসলিম রূপে বেড়ে উঠতে। ইতিহাসে সে প্রমানও রয়েছে। তখন মুসলিম দেশ বিশ্বরেকর্ড গড়ে উন্নত নীতি-নৈতিকতায় নয়, বরং সীমাহীন দুর্নীতিতে। এ শতাব্দীর গোড়াতে বাংলাদেশ যেভাবে পর পর ৫ বার দুর্নীতে বিশ্বরেকর্ড গড়ে –সেটিই প্রমাণ করে দেশটিতে সোশাল রেফাইনারিগুলি কতটা ভয়ানক ভাবে বিকল। নিকোবর বা পাপুয়া নিউগিনির যে মানুষগুলো উলঙ্গ হয়ে বনেজঙ্গলে পশুদের মত গুহায় বাস করে সেটির কারণ, সাধারণ মানব থেকে তাদের দৈহিক ভিন্নতা নয়, বরং সেটি হলো সোসাল রিফাইনারির মধ্য দিয়ে পরিশোধিত না হওয়ার ফল। এরফলে এসব হতভাগ্য মানব শিশুগণ পুরাপুরি অপরিশুদ্ধ তথা খামই রয়ে যায়। ফলে বাসস্থান ও পানাহারের সন্ধানে তাদের প্রতিযোগিতা দিতে হয় বনের বানর-শৃগালদের সাথে। দেশের দায়িত্বহীন সরকার তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে টুরিস্টদের জন্য দর্শণীয় জীব রূপে।
পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে পরিশোধনের যে চলমান প্রক্রিয়া সেটিই হলো ইসলামের তাহযিব। তাহযিবের আভিধানিক অর্থ হলো পরিশুদ্ধি করণ। বস্তুতঃ এটিই হলো ইসলামের সংস্কৃতি -যা মানব সন্তানকে মুসলিম রূপে গড় তোলে। মুসলিমদের পতনের কারণ কোন ভূমিকম্প বা সুনামী নয়, অর্থনৈতীক ব্যর্থতাও নয়। বরং সেটি হলো অকার্যকর তাহযিব তথা সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া। রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে স্রেফ শাসকের ভোগের আয়োজনে সমৃদ্ধি আনার হাতিয়ারে। ফলে মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েও মুসলিম সন্তান ব্যর্থ হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠতে। ব্যর্থতার সে চিত্রটি আরো সুস্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে যখন তারা ইসলামকে বিজয়ী করার বদলে নিজেদের অর্থ, শ্রম ও রক্তের বিনিয়োগ করে জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সমাজবাদ, স্বৈরাচার ও সেক্যুলারিজমকে বিজয়ী করার যুদ্ধে। তাই মুসলিম ভূমিতে কাফেরগণ লক্ষ লক্ষ দাস সৈনিক পায়। নিজ ধর্ম ও নিজ উম্মাহর সাথে তাদের বিশ্বাসঘাতকতার ভয়ানক চিত্রটি হলো, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দশ লাখের বেশী আরব মুসলিম এবং দুই লাখের বেশী ভারতীয় মুসলিম যুদ্ধ করেছে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে বিজয়ী করতে। উসমানিয়া খেলাফা পরাজিত ও বিলুপ্ত হয়েছে, মুসলিম রাষ্ট্রগুলি ক্ষুদ্রতর হয়েছে, কাফেরদের হাতে মুসলিম ভূমি অধিকৃত হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গণে ইসলাম পরাজিত হয়েছে বস্তুতঃ মুসলিমদের নিজেদের হাতে। মুসলিমগণ মুসলিম রূপে বেড়ে উঠতে কতটা ব্যর্থতা হয়েছে এ হলো তার নমুনা।
ব্যর্থতা যেখানে কোর’আন বুঝায়
ইসলামের সোশাল ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের মূল হাতিয়ারটি হলো পবিত্র কোরআন। কোর’আনের জ্ঞান ছাড়া ইসলামের সোশাল রিফাইনারিগুলো অচল হতে বাধ্য। মুসলিমের সাফল্য তো প্রকৃত মুসলিম রূপে বেড়ে উঠায়। সে কাজটি জলবায়ু, ঘর-বাড়ী, বা পানাহারে হয় না। এজন্য অপরিহার্য হলো তার ঈমানের পুষ্টি। ঈমান সে পুষ্টি পায় কোর’আনের জ্ঞান থেকে। সেটি না হলো উন্নত ঘরবাড়ীর সুঠাম বাসিন্দাও ভয়ানক চোর-ডাকাতে পরিণত হয়। নামাযে বা নামায শেষে জায়নামাযে বসে সুরা তেলেওয়াত করলেই কোর’আন পাঠের ফরজ আদায় হয় না। নামাযের নিয়েত বেঁধে যে সুরাগুলি জায়নামাযে তেলাওয়াত করা হয় তার মূল লক্ষ্যটি নামায আদায়। সে তেলাওয়াতে জ্ঞানার্জনের নিয়েত থাকে না, ফলে জ্ঞানার্জনের ফরজও তাতে আদায় হয়না। জ্ঞানার্জনের নিয়েত নিয়ে তাই কোরআন পাঠ করতে হয় নামাযের বাইরে। কোর’আন পাঠে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলোঃ এক). আয়াতগুলির অর্থ বুঝা, দুই). সেগুলি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা এবং তিন). বাস্তব জীবনে সে কোর’আনী জ্ঞানের প্রয়োগ। না বুঝে বার বার কোর’আন তেলাওয়াতে জ্ঞানার্জনের ফরজ আদায় হয় না। এরূপ কোর’আন পাঠের ফলে জাহেল বা অজ্ঞ থাকার পাপ থেকে মুক্তি ঘটে না।
কোরআন বুঝা এতো কঠিন নয় যতটা কঠিন ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার বা অন্য কোন পেশায় প্রফেশনাল পরীক্ষায় পাশ করা। সামান্য কয়েক দশকের সুখ-শান্তি বাড়াতে ছাত্রদের জীবনে সময় ও মেধার বিনিয়োগটি বিশাল। বছরের পর বছর ধরে, রাতের পর রাত জেগে, তারা বিশাল বিশাল বইয়ের হাজার হাজার পৃষ্ঠা বার বার পড়ে ও মুখস্থ করে। অথচ হাজার হাজার ট্রিলিয়ন বছরেও শেষ হবার নয় এমন এক অনন্ত অসীম কালের সুখশান্তি বাড়াতে অপরিহার্য যে কোরআনী জ্ঞানের পথনির্দেশনা –সে জ্ঞান বাড়াতে ছাত্রদের বিনিয়োগ বা মেহনত কতটুকু? সে অবহেলার কারণে ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার বা অন্য কোন পেশায় তাদের সফলতা মিললেও বিপদে পড়ছে মুসলিম হওয়াটি। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণা, “একমাত্র (পবিত্র কোরআনের জ্ঞানে) জ্ঞানবানগণই আমাকে ভয় করে।” মুসলিম হওয়ার জন্য জ্ঞানবান হওয়া তাই অপরিহার্য। চিকিৎসা বিজ্ঞানের জ্ঞান ছাড়া যেমন ডাক্তার হওয়া যায় না, তেমনি অসম্ভব হলো পবিত্র কোর’আনের জ্ঞান ছাড়া মুসলিম হওয়া। মুসলিম জীবনে মহাপাপ হলো অজ্ঞ বা জাহেল থাকা। মহান আল্লাহতায়ালা আমলের সংখ্যা দেখেন না, দেখেন ওজন। আর ওজন বাড়ে জ্ঞানের মিশ্রণ ঘটায়।
কিন্তু মুসলিমদের মাঝে পবিত্র কোরআ’ন থেকে জ্ঞানার্জনের সে চেষ্টা কই? যে পরিমান সময়, শ্রম ও মেধা তারা প্রফেশনাল জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য ব্যয় করে তার সিকি ভাগ সময় কোরআন বুঝার পিছনে ব্যয় করলে কোর’আনের উপর গভীর জ্ঞানলাভ হতো। তখন সে জ্ঞানে সহজ হতো সিরাতুল মুস্তাকীম প্রাপ্তি এবং সে সাথে জান্নাত-প্রাপ্তি। তাছাড়া কোর’আনের এ জ্ঞানার্জন এতটা কঠিনও নয় যতটা ভাবা হয়। এ নিয়ে মুসলিমদের মাঝে বিরাজ করছে প্রচণ্ড ভাষাগত ভীতি। অথচ কোর’আনের ভাষা অন্য বহু ভাষার চেয়ে সহজ। বাংলা ভাষার মধ্যেই রয়েছে বহু আরবী শব্দ। কোর’আনের ভাষা সহজ হওয়ার কারণেই এ পবিত্র কিতাব মাতৃভাষা পাল্টিয়ে দিয়েছে ইরাক, সিরিয়া, মিশর, লিবিয়া, আলজিরিয়া, মরক্কো, মালি, সূদানসহ বহু দেশের মানুষের। অথচ আরবী ভাষা শিক্ষা দেয়ার জন্য সে সময় মুসলিম ভূমিত কোন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বা ভাষা ইন্সটিটিউট ছিল না। সরকারি উদ্যোগে গ্রামে গ্রামে শিক্ষক প্রেরণের আয়োজনও ছিল না। মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ এ দান থেকে কিছু সংগ্রহের আগ্রহই সে কাজকে সেদিন সহজ করে দিয়েছিল। আরো লক্ষণীয় হলো, পবিত্র কোরআনের অতি প্রসিদ্ধ মোফাচ্ছিরগণ গড়ে উঠেছে অনারবদের মধ্য থেকে। সে উদাহরণ হলো, তাবারিস্তানের আত-তাবারী, ইরানের আল-রাযী, আধুনিক ভারতের ইউসুফ আলী।
এটিও সত্য এবং অতি বাস্তব যে, পবিত্র কোর’আন গভীর ভাবে বুঝতে হলে সে বুঝার কাজটি হতে হবে কোর’আনের ভাষাতেই। অনুবাদ পড়ে সেটি সম্ভব নয়। পবিত্র কোরআনের মাঝে রয়েছে প্রচণ্ড ইমোশনাল, ইন্সপিরেশনাল ও ইনটেলেকচুয়াল ফোর্স। এর অনুবাদ কোন ভাবেই সম্ভব নয়। ফলে অনুবাদ পড়ে কারো দিল কেঁপে উঠে না, চোখেও পানি আসে না। এমন কি মুসলিম ভূমি কাফেরদের হাতে অধিকৃত হলেও জিহাদের ময়দানে ছুটে যাওয়ার জজবা সৃষ্টি হয়না। কিন্তু দিল কাঁপে, চোখে পানি আসে ও জিহাদের ময়দানে ছুটে যাওয়ার জজবা সৃষ্টি হয় আরবী ভাষা বুঝে কোরআন পাঠ করলে। কোর’আন না বুঝে তেলাওয়াতের কারণেই মুসলিমদের সংখ্য বিপুল ভাবে বাড়লেও ইসলাম পালন হচ্ছে না। ইসলামের বিজয়ও বাড়ছে না। তবে যারা জালেম, গাফেল, দুনিয়াদার ও পাপী, তাদের মাতৃভাষা আরবী হলেও কোর’আন থেকে শিক্ষা নেয়ার সামর্থ্য তাদের থাকে না। আবু লাহাব, আবু জাহেলগণ তাই পায়নি। আজকের দুর্বৃত্ত আরব জালেমগণও পাচ্ছে না। কারণ, জালেমদের হিদায়েত না দেয়াটিই হলো পবিত্র কোর’আনে ঘোষিত মহান আল্লাহতায়ালার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি।
মুসলিম ইতিহাসের কালো অধ্যায় ও তার কারণ
এ সত্য অস্বীকারের উপায় নেই, খলিফা রাশেদার বিলুপ্তি কোন কাফের শক্তির হাতে হয়নি। হয়েছে মুসলিমদের হাতে। এর হেতু কি? এর মূল কারণ, খোলাফায়ে রাশেদার শেষ দিনগুলিতে মুসলিমদের নিজেদের মাঝে বিচ্যুতি। সে বিচ্যুতিটি ঘটেছিল নবীজী (সাঃ) শিক্ষা থেকে দূরে সরায়। খোলাফায়ে রাশেদাকে বিলুপ্ত করে স্বৈরাচারি শাসনে রূপ দেয়ার কাজে সে সময় যারা নেতৃত্ব দেন তাদের কেউই প্রাথমিক যুগের সাহাবা ছিলেন না। তারা মুসলিম হয়েছিলেন মক্কা বিজয়ের পর। এক কালের মুশরিক-সর্দার আবু সুফিয়ানের পুত্র হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) ছিলেন তাদেরই একজন। ইসলামের ইতিহাসে তারা পরিচিত ‘তোলাকা’ রূপে। তারা ফিরিয়ে আনে নিজেদের গোত্রীয় শাসনকে। খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যে কবিরা গোনাহ ও জঘন্য হারাম -সে য জ্ঞানের প্রমাণও তারা রাখতে পারেনি। একতার বদলে বিভক্তি গড়া তাদের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। প্রশ্ন হলো, এরই বা কারণ কি? ভাবতে হবে তা নিয়েও।
নবুয়ত প্রাপ্তির শুরু থেকেই মহান নবীজী (সাঃ) মুসলিমদের মাঝে জ্ঞান, ধ্যান-ধারণা ও চেতনা-চরিত্রের পরিশুদ্ধির যে প্রক্রিয়াও শুরু করেন সেটিই হলো সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লবী ঘটনা। নবীজী (সাঃ)র পরিচালনায় প্রতিষ্ঠা পায় এমন এক সামাজিক রিফাইনারি -যা জন্ম দেয় পরিশুদ্ধ চেতনা-চরিত্রের অধিকারি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। যারা পরিচিতি পায় নবীজী (সাঃ)র সাহাবা রূপে। সে সামাজিক রিফাইনারির মূল উপাদানটি ছিল পবিত্র কোর’আনের জ্ঞান ও নবীজী (সাঃ)র নেতৃত্ব। এবং সে ইসলামী রিফাইনারিটি নিয়মিত নজদারী ও দিক-নির্দেশনা পেয়েছিল খোদ মহান আল্লাহতায়ালা থেকে। নবীজী (সাঃ)র ইন্তেকালের পর মহান আল্লাহতায়ালার সাথে মুসলিম উম্মাহর সে সংযোগের ইতি ঘটে।
প্রশিক্ষণের অপরিহার্য অংশ রূপে স্রেফ জ্ঞানদান ও নামায-রোযা নয়, মহান নবীজী (সাঃ) সাহাবাদেরকে জিহাদের ময়দানেও হাজির করেছিলেন। লাগাতর জিহাদে অংশ নেয়ায় পরিপক্কতা পায় তাদের ঈমান। ইসলামী রাষ্ট্রের ন্যায় একটি আদর্শিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দেয়া এবং সেটিকে লাগাতর টিকে রাখার জন্য এমন এক সোশাল রিফাইনারীর গুরুত্বটি অপরিসীম। মক্কার বুকে ১৩ বছর ধরে চলে সে প্রশিক্ষণ। মানব ইতিহাসের বুকে কোন কালেই এতটা সফল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা পায়নি। সে প্রশিক্ষণের অংশ রূপে শোবে আবু তালেবে তিন বছর অন্তরীণ থাকা কালে নবীজী (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবাদেরকে অনাহারে গাছের পাতাও খেতে হয়। নবীজীর জীবনে সে তিনটি বছর ছিল সবচেয়ে কঠিন দিন। সে প্রশিক্ষণে শামিল ছিলেন নবীজী (সাঃ)র প্রথম স্ত্রী হযরত বিবি খাদিজা (রাঃ)। নবীজী (সাঃ)র জীবনে তিনিই ছিলেন তাঁর শ্রেষ্ঠ স্ত্রী। ইসলামের ইতিহাসের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবজনক কর্মের নায়ক হলেন তারা -যারা ছিলেন ইসলামের সে শ্রেষ্ঠ সোশাল রিফাইনারিতে পরিশুদ্ধ হওয়া সাহাবা। তাদের মধ্য থেকে ১০ জন জীবিত অবস্থাতেই জান্নাতের প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন। অথচ পরবর্তীতে যারা মুসলিম হয়েছেন তাদের বিপুল সংখ্যার মধ্য থেকে সে সৌভাগ্য একজনের হয়নি। মদিনায় হিযরত করার পর ইসলামে দাখিল হওয়া মুসলিমগণ এবং নবীজী (সাঃ)র পরবর্তী কালের স্ত্রীগণ মক্বী জীবনের সে প্রচণ্ড প্রশিক্ষণ পাননি। সেটিই বিপদ ঘটায় খোলাফায় রাশেদার শেষ দিনগুলিতে।
নবীজী (সাঃ)র ইন্তেকালের পর ইসলামের সে সোশাল রিফাইনারি বোধগম্য কারণেই দুর্বল হয়ে পড়ে। সংকটের প্রতিক্ষণে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নির্দেশনা আসাও বন্ধ হয়ে যায়। সে বিপদ বুঝে হযরত আবু বকর (রাঃ) নবীজী (সাঃ)র ইন্তেকালের খবর শুনে কেঁদেছিলেন। হযরত আলী (রাঃ) যখন খলিফা হন তখন নবীজী (সাঃ)র নিজ হাতে গড়া প্রথম সারির সাহাবাদের অধিকাংশই ইতিমধ্যে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। রাজনীতির অঙ্গণে তখন ভীড় জমে উঠে তোলাকাদের। নবদীক্ষিত এ মুসলিমদের সংখ্যা দ্রুত বাড়লেও তাদের মাঝে কাঙ্খিত জ্ঞানগত, চেতনাগত ও চারিত্রিক পরিশুদ্ধি প্রথম সারির সাহাবাদের ন্যায় সৃষ্টি হয়নি। মুসলিম রাষ্ট্রের বিস্তার বহুগুণ বাড়লেও সে সুবিশাল রাষ্ট্র জুড়ে সোশাল রিফাইনারী গড়ে উঠেনি। ফলে তাদের মাঝে নৈতীক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব অপূর্ণ থেকে যায়। এর ফলে সৃষ্টি হয় ভয়ানক প্রাতিষ্ঠানিক, সাংস্কৃতিক ও চেতনাগত শূণ্যতা। সে সাথে ছিল বিভিন্ন প্রদেশে দায়িত্বপালনে লিপ্ত নেতাদের মাঝে মারাত্মক যোগাযোগ-শূণ্যতাও। চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে সিরিয়ার মুসলিমগণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে মক্কা-মদিনা, ইরাক বা মিশরের মুসলিমদের থেকে। ফলে সৃষ্টি হয় ভূল বুঝাবুঝি এবং তা থেকে শুরু হয় ভয়ানক ভাতৃঘাতি যুদ্ধ। ফলে মানব ইতিহাসের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং খলিফায়ে রাশেদার একজন শ্রেষ্ঠ খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ন্যায় হারাম কাজও সেদিন সংঘটিত হয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদা বিলুপ্ত হওয়ার এ হলো মূল কারণ। ভবিষ্যতের মুসলিমদের জন্য এ বিয়োগান্ত ঘটনার মধ্যে রয়েছে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় দিক।
যে মহাবিপদে মুসলিম উম্মাহ
এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে শিক্ষণীয় বিষয়টি হলো, ধর্মান্তর বা রাষ্ট্রের আয়োতনে দ্রুত বৃদ্ধি ঘটালেই চলে না, দ্রুত বিপ্লব আনতে হয় নাগরিকদের জ্ঞান, চেতনা ও সংস্কৃতির অঙ্গণেও। রাজনৈতিক, আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে তীব্রতর করতে হয় এক সাথে। মুসলিম ইতিহাসের কালো অধ্যায়গুলি বুঝতে হবে মুসলিম সমাজের সে অনাকাঙ্খিত প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখেই। তবে এরূপ নানা দুর্বলতা ও ব্যর্থতার পরও তাদের যে অবদান -সেটিও অতি বিশাল। তাদের আমলেই এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিশাল এলাকা জুড়ে মুসলিমদের বিজয় ঘটে। সে সব দেশের বিপুল সংখ্যক জনগণ মুসলিম হতে পেরেছে তাদের সে অবদানের কারণেই।
গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হলো, স্বৈরাচারি উমাইয়া, আব্বাসীয়, উসমানিয়া বা মোগল শাসকদেরকে কখনোই ইসলামের আদর্শ ব্যক্তি রূপে গণ্য করা যায় না। যেমন আদর্শ মুসলিম রূপে গণ্য করা যায় না, মুজিব, হাসিনা ও সৌদি রাজাদের ন্যায় বর্তমান যুগের স্বৈরাচারি শাসকদের। এরা প্রতিনিধিত্ব করে নিজের কদর্য চেতনা ও চরিত্রের, ইসলামের নয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ঈমানের পরীক্ষায় সবাইকে নিজ সামর্থ্যে পাশ করতে হয়। পিতা বা স্বামী নবী-রাসূল ছিলেন বা বিখ্যাত সাহাবী ছিলেন -সে কারণে কেউ পরীক্ষায় পাশ করে না। হযরত আদম (আঃ) ও হযরত নূহ (আঃ)’র পুত্র যেমন সে পরীক্ষায় পাশ করেনি, তেমনি পাশ করেনি হযরত লুত (আঃ)’র স্ত্রী। তবে অতীতের মুসলিমদের ভূল-ভ্রান্তি যাই হোক, তা নিয়ে বিচারের মুখোমুখি তারা নিজেরা হবে। আমাদের কাজ হলো, নিজেদের ব্যর্থতা থেকে নিজেদের বাঁচানো। সে জন্য জরুরী হলো, অতীতের মুসলিমদের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেয়া। বুঝতে হবে, নিজেকে বাঁচানোর সে কাজে অতি অপরিহার্য হলো, কোর’আনী জ্ঞান, সে জ্ঞানের প্রয়োগ। তবে ইসলামীকরণের লক্ষ্যে আরো জরুরী হলো, পরিপূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্র ও তার পূর্ণ অবকাঠামো গড়ে তোলা। একমাত্র এ পথেই প্রতিটি পরিবার এবং প্রতিটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ইসলামের সোসাল রিফাইনারী রূপে গড়ে উঠে। সেগুলি তখন কাঙ্খিত পরিশুদ্ধি আনে সেখানে বসবাসকারি প্রতিটি নরনারীর জীবনে। নইলে বিপন্ন হয় মুসলিমদের মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা। তখন মুসলিম ভূমিতে বিজয় বাড়ে শত্রুপক্ষের। শত্রুশক্তির হাতে অধিকৃত হওয়ার ফলে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন, আইন-আদালতসহ রাষ্ট্রের সমগ্র অবকাঠামো ব্যবহৃত হয় নাগরিকদের ইসলাম থেকে দূরে সরানোর কাজে। যে কাজ এক কালে করতো দখলদার বিদেশী কাফের শত্রুগণ, আজ সেটিই করছে ইসলামের দেশী শত্রুগণ । তাদের সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের ফলে জনগণ মুসলিম রূপে পরিচয় দিলেও শত্রুতে পরিণত হয় ইসলামী রাষ্ট্র, শরিয়ত, হুদুদ, জিহাদ ও প্যান-ইসলামিক ঐক্যের ন্যায় ইসলামের মৌল বিষয়ের বিরুদ্ধে। এমন রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম হলেও সেখানে সহজ হয় জাহান্নামের পথে চলা এবং কঠিন হয় জান্নাতের পথ খুঁজে পাওয়া। বাংলাদেশসহ অধিকাংশ মুসলিম দেশে তো সেটিই হচ্ছে। ০২/০২/২০১৯
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018