বাংলাদেশে মৃত গণতন্ত্র এবং  বিজয় স্বৈরাচারি অসভ্যতার  

যে নিরেট অসভ্যতা স্বৈরাচারে

স্বৈরাচার কোন কালেই দেশ শাসনের সভ্য রীতি ছিল না। ধর্মের নামে কোটি কোটি মানুষের জীবনে মুর্তিপূজা, শাপপূজা, গরুপূজা, লিঙ্গ পূজার ন্যায় সনাতন অপধর্ম ও অসভ্যতা যেমন এখনো বেঁচে আছে, তেমনি রাজনীতির নামে বহুদেশে প্রকট ভাবে বেঁচে আছে স্বৈরাচারের নগ্ন অসভ্যতাও। বাংলাদেশ তেমনি এক স্বৈরাচার কবলিত দেশ। কদর্য অসভ্যতার প্রকাশ শুধু পোষাক-পরিচ্ছদ, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ধর্মপালন ও যৌন জীবনে থাকে না, থাকে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও। বস্তুত রাজনীতির অঙ্গণে সে আদিম অসভ্যতাটি হলো স্বৈরাচার। অন্যান্য অসভ্যতার তুলনায় স্বৈরাচারি অসভ্যতার নাশকতাটি ভয়াবহ ও ব্যাপক। পতিতালয়ের অসভ্যতা বাইরের অন্যদের সভ্য রূপে বেড়ে উঠার অধিকারকে কেড়ে নেয় না। কিন্তু স্বৈরাচারের অসভ্যতায় নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস ও রাজনৈতীক মতবাদ নিয়ে বেড়ে উঠার স্বাধীনতাই শুধু বিলুপ্ত হয় না, কেড়ে নেয়া হয় প্রতিপক্ষের প্রাণে বাঁচার স্বাধীনতা টুকুও। তখন রাষ্ট্র ও জনগণের ভাগ্য নির্ধারণের সবটুকু ক্ষেত্র জুড়ে প্রতিষ্ঠা পায় একমাত্র স্বৈরশাসকের দখলদারি। সে অধিকৃত ভূমিতে অন্য কারো স্থান না দেয়াই স্বৈরাচারের রীতি। স্বৈরশাসকের জন্য সে স্থানটি নিরাপদ করতেই অন্যদের নির্মূল করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। স্বৈরাচারি অসভ্যতার ফসল তাই একদলীয় শাসন, গণহত্যা,গণনির্যাতন ও গণনির্মূল।

বাংলাদেশে স্বৈর শাসনের অসভ্য  রূপটি যেমন  একদলীয় বাকশালী শাসনামলে দেখা গেছে, তেমনি দেখা যাচ্ছে শেখ হাসিনার শাসনামলেও। দেখা গেছে এরশাদের আমলেও। তবে অসভ্যতার বড় নাশকতাটি হলো এতে মৃত্যু ঘটে লজ্জা-শরম ও বিবেকবোধের। একারণেই স্বৈর শাসকগণ লজ্জা পায় না ভোটারহীন নির্বাচন ও অর্ধেকের বেশী সিটে ভোটকেন্দ্র না খুলে নিজেকে নির্বাচিত প্রধান মন্ত্রী রূপে ঘোষণা দিতে। সেটি আরো দেখা গেল ২০১৮ সালের ব্যালট ডাকাতির নির্বাচনে। ভদ্র মানুষ কখনোই অন্যের পকেটে হাত দেয় না। কিন্তু স্বৈর শাসক অন্যের জীবনে হাত দেয় এবং তাকে লাশে পরিণত  করে। তাতে সে সামান্যতম শরম বোধও করে না। নিজেকে অপরাধীও মনে করে না। এটিই হলো স্বৈর শাসকদের নিরেট নৈতীক বিবস্ত্রতা। এরূপ অবস্থার কারণেই সিরাজ শিকদারকে বিনা বিচারে হত্যার পর সংসদে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিব দরাজ গলায় বলতে পেরেছিলেন,কোথায় আজ সিরাজ শিকদার? কাউকে খুন করার পর জনসম্মুখে এমন চিৎকার করার ক্ষমতা সব খুনির থাকে না, কারণ সে জন্য নৈতীক দিক দিয়ে অনেক নীচে নামতে হয়। কিন্তু স্বৈর শাসকগণ সেটি পারে; এবং সে জন্যই তারা স্বৈর শাসক। কোন নির্বাচিত সরকার কি কখনো ভাবতে পারে, দেশের বিরোধী দলীয় নেত্রীর গৃহের সামনে বালির ট্রাক পাঠিয়ে তাঁকে অবরুদ্ধ করা হবে? সভ্য দেশে কোন কালেই কি সেটি ঘটেছে? কারণ, সেটি করলে নির্বাচনি ভোটে সরকারকে সে অসভ্য কর্মের জন্য শাস্তি পেতে হয়। কিন্তু স্বৈরশাসকের ভোটের ভয় থাকে না। কারণ স্বৈর শাসক ক্ষমতায় আসে তো ভোট ডাকাতির মাধ্যেম, জনগণের ভোটে নয়। ব্যালট পেপার যেহেতু স্বৈর শাসকের ছাপখানায় থাকে, ফলে তাদের আর ভোটের ভয় কিসের? তাই বাংলাদেশের ন্যায় যে সব দেশে প্রচণ্ড স্বৈরাচারি অসভ্যতা সেসব দেশে তেমনটি ঘটা মামূলী ব্যাপার মাত্র।

 

নাশকতা বেড়েছে শতগুণ

বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও শক্তিশালী রাষ্টীয় অবকাঠামোর কারণে স্বৈর শাসক অধিকৃত দেশগুলিতে অসভ্যতার নাশকতা বেড়েছে শতগুণ। অত্যাধুনিক অস্ত্র, সশস্ত্র পুলিশ, বিশাল সেনাবাহিনী, গুপ্তচর বাহিনী এবং গৃহপালিত বিচারকদের কারণে বিপুল ভাবে বেড়েছ পরিকল্পিত হত্যা, গণহত্যা, গুম, নির্যাতন ও ফাঁসি। পূর্বকালে ছিল গোত্রপতি বা রাজার স্বৈরাচার। অথচ রাজনৈতিক অঙ্গণে এখন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে রাজনৈতীক দলের নেতা-নেত্রীর স্বৈরাচার। স্বৈরাচারে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার, তাদের ইচছা-অনিচ্ছা এবং কোনটি ন্যায় বা অন্যায় সে বিষয়গুলি আদৌ ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয় না। বরং কাজ করে শাসকের নিজের ইচছা বা অনিচ্ছা তা যত অসভ্য ও অন্যায্যই হোক। আরো বিপদ এ কারণে যে, স্বৈর শাসকের সে স্বেচ্ছাচারিতা কেবল রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তা নির্ধারণ করে দেশের ধর্ম, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইন-আদালত -এমন কি দেশের ইতিহাসে কি শেখানো হবে সে বিষয়গুলিও। তারই উদাহরণ, স্বৈরাচারি রোমান সম্রাট কন্সটান্টটাইন যখন খৃষ্টান ধর্ম কবুল করে, তখনই সাম্রাজ্যের সকল প্রজার জন্য খৃষ্টান হওয়াকে বাধ্যতা মূলক করা হয়। কোন অখৃষ্টানকে তাঁর সাম্রাজ্যে প্রাণে বাঁচার অধিকার দেয়া হয়নি। তেমনি ফিরাউনও বেঁচে থাকার অধিকার দেয়নি হযরত মূসা (আঃ), হযরত হারুন (আঃ) এবং তাদের স্বগোত্রীয় ইহুদীদের।

শেখ মুজিবও নিজের দুষমন নির্মূলে নিষিদ্ধ করেন দেশের সকল বিরোধী দলগুলিকে। রাজনীতির অঙ্গণে অন্যদের জন্য সামান্যতম স্থানও তিনি ছেড়ে দেননি। অন্যদের জন্য একটি মাত্র পথই তিনি খোলা রাখেন সেটি হলো, তাঁর নিজের দল বাকশালে শরীক হয়ে তাঁর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের রাজনীতি। সে আনুগত্য না মেনে রাজনীতির ময়দানে যারাই সক্রিয় থাকার চেষ্টা করেছে রক্ষিবাহিনী লেলিয়ে তাদের জীবন কেড়ে নেয়া হয়েছে। প্রাণ কেড়ে নেয়া হয়েছে তিরিশ হাজারের বেশী বিরোধী নেতাকর্মীর। অন্যান্য স্বৈর-শাসকদের ন্যায় শেখ মুজিবের স্বৈরাচারও রাজনীতিতে সীমিত থাকেনি। বাংলাদেশের ইতিহাসে কি লিখতে হবে সে বিষয়গুলিও তিনি নির্ধারণ করে দেন । ফলে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে কতজন নিহত হয় সে সংখ্যাটি বের করার দায়িত্ব তিনি কখনোই দেশের লোকগণনা ও পরিসংখ্যান বিভাগকে দেননি। বরং সেটি নির্ধারণ করে দেন তিনি নিজে। এবং সে সংখ্যাটির ঘোষণা দেন পাকিস্তান থেকে ফেরার পথে লন্ডনের বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনা কালে। অথচ সে সঠিক সংখ্যাটি ঘরে ঘরে ঘুরে পরিসংখ্যাণ না নিয়ে কোন ব্যক্তির পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় বলেই সে সংখ্যাটি নির্ণয় করতে প্রতি দেশে লোকগণনা বিভাগের হাজার হাজার কর্মিকে মাঠে নামানো হয়। অথচ সে পথে না গিয়ে এস জটিল সংখ্যাটি নির্ণয়ে  শেখ মুজিব তাঁর জিহ্ববা ও লাগামহীন কল্পনাকে কাজে লাগিয়েছেন। ফলে সেকেন্ডের মধ্যে সে সংখ্যাটি ৩০ লাখে নির্ধারণ করে দেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের বইয়ে এখন সে কল্পিত তথ্যটি ইতিহাস রূপে পড়তে হয়। এরং দেশের কোটি কোটি নাগরিককে সে মিথ্যা তথ্যটিই বলতে হয় সর্বত্র। সে মিথ্যার প্রতিবাদ করাকে শেখ মুজিবের অসম্মান বলে দণ্ডনীয় করা হয়েছে।

স্বৈরাচারি শাসকের হাতে এভাবে শুধু অসংখ্য মানুষই মারা যায় না, মারা পড়ে প্রকৃত সত্য এবং দেশের সত্য ইতিহাসও। ইসলামের বিধানে প্রতিটি মিথ্যাই জঘন্য পাপ। কি রাজনীতি, কি ধর্ম, কি ইতিহাস এবং কি সমাজ-সংসার সর্বত্র জুড়ে যত পাপ তার জন্ম মূলতঃ মিথ্যা থেকে। নবীজী (সাঃ) তাই মিথ্যাকে সকল পাপের মা বলেছেন। মিথ্যার কারণেই মুর্তি, শাপ-শকুন, ও গরুর ন্যায় পশু এবং ফিরাউনের ন্যায় বহু দুর্বৃত্তও ভগবান রূপে গৃহিত হয়েছে। মিথ্যার স্তুপের মাঝে সত্যের সন্ধান মেলে না। এজন্যই মিথ্যার স্তুপ সরাতেই মহান আল্লাহতায়ালা লক্ষাধিক নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ তাই বর্ণ, ভাষা বা ভূমি নিয়ে নয়, সেটি হলো মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের যুদ্ধ। যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ দাঁড়িয়েছেন সত্যের পক্ষে এবং শয়তান ও তার সেবকগণ দাঁড়িয়েছে মিথ্যার পক্ষে। ইসলামে সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কর্ম তাই মিথ্যার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। অথচ সে সামর্থ্য স্বৈরশাসকদের থাকে না। বরং গদি বাঁচানোর স্বার্থে তারা শুধু নিজেরাই মিথ্যাচারি হয় না, মিথ্যাচারি বানায় জনগণকেও। স্বৈর শাসকের অধিকৃত দেশে এজন্যই প্রবল জোয়ার সৃষ্টি হয় নিরেট মিথ্যার। মিথ্যার সে জোয়ারের কারণেই মুর্তিরা পূজা পায় এবং ফিরাউনের ন্যায় দুর্বৃত্তগণও ভক্ত পায়। সে অভিন্ন কারণে মুজিবভক্তদের কাছে মুজিব গণ্য হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে।

 

আক্রোশ কেন ইসলামের বিরুদ্ধে?

ইসলাম কখনোই স্বৈরশাসন, স্বৈরাচারি মিথ্যাচার এবং স্বৈরাচারি বর্বরতাকে সমর্থণ করে না। নবীজী (সাঃ)র আগে আরবে খৃষ্টান ছিল, ইহুদীগণও ছিল। কিন্তু তারা গোত্রপতিদের বর্বর স্বৈরাচার নির্মূলে কোনদিন যুদ্ধ করেনি। বরং বেছে নিয়েছিল শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের নীতি। কিন্তু নবীজী (সাঃ) তাদের নির্মূলে নেমেছেন। শতকরা ৭০ জনের বেশী সাহাবা সে জিহাদের শহীদও হয়েছেন। কারণ স্বৈরাচারের অসভ্যতা নির্মূল না করলে কি সভ্য সমাজের নির্মাণ সম্ভব? ফলে যারা নবীজী (সাঃ)র সূন্নতের নিষ্ঠাবান অনুসারি তাদের জীবনে স্বৈর শাসন নির্মূলের জিহাদটি অনিবার্য কারণেই এসে যায়। একারণেই তাদের বিরুদ্ধে স্বৈর-শাসকদের আক্রোশটি প্রকট। অথচ সেরূপ আক্রোশ অন্য ধর্মের অনুসারিদের বিরুদ্ধে থাকে না। এ জন্যই ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটি প্রতিটি স্বৈর শাসকের স্বভাবজাত বিষয়। মুসলিম দেশে তারা বন্ধু খুঁজে মুসলিম উম্মাহর বাইরে থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈর শাসকদের ঘনিষ্ট সম্পর্কের মূল কারণ তো ইসলাম ও মুসলিম ভীতি। সে ভীতি নিয়ে সৌদি আরব ও মিশরের জেলগুলি পূর্ণ করা হয়েছে মুসলিম উলামা দিয়ে। একই রূপ ইসলাম ও মুসলিম ভীতি নিয়ে ইরানের সাবেক স্বৈরাচারি শাসক মহম্মদ রেজা শাহ পুলিশ, গুপ্তচর বাহিনী ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিল ইরানে বসবাসরত অমুসলিম বাহাই ও ইহুদীদের। এক্ষেত্রে শেখ হাসিনার নীতিও ভিন্নতর নয়। নিজের স্বৈরাচার বাঁচাতে তাঁর কোয়ালিশনটিও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের সাথে নয়, বরং বিশ্বের সর্ববৃহৎ পৌত্তলিক শক্তি ভারতের সাথে। শেখ হাসিনার সে ইসলাম মুসলিম ভীতি কাজ করছে বাংলাদেশের পুলিশ, বিচার ও প্রশাসনিক বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে বিপুল সংখ্যায় হিন্দুদের নিয়োগ দেয়ার পিছনেও।

কাউকে সঠিক ভাবে চেনার সহজ ও নির্ভূল পদ্ধতিটি হলো তার বন্ধুদের চেনা। কারণ, কেউই তার বিপরীত চেতনার মানুষকে অন্তরঙ্গ বন্ধু রূপে গ্রহণ করে না। জনগণকে ধোকা দিতে কখনো ধর্ম, কখনো গণতন্ত্রের মুখোশ পড়লেও বন্ধুদের সামনে হাজির হয় মুখোশ সরিয়ে। তাই যে ব্যক্তি ভারতকে চিনতে ভূল করে না, সে ভূল করে না হাসিনাকে চিনতেও। সেটি দেখা গেছে পাকিস্তান আমলেও। যারা সে আমলে ভারতের এজেন্ডাকে চিনতে ভুল করেনি, একমাত্র তারাই সেদিন শেখ মুজিবকে চিনতে ভুল করেনি। ফলে মুজিবকে নিয়ে তারা সেদিন যা কিছু বলেছিল সেটিই ফলেছে তার শাসনামলে। তেল ও পানি যেমন একত্রে মেশে না, তেমনি রাজনীতিতে বিপরীত মতের মানুষের মাঝে কখনোই একতা গড়ে উঠে না। আদর্শিক ও কালচারাল ম্যাচিংটি এক্ষেত্রে অপরিহার্য়। একারণেই ভারত কোন ইসলামপন্থিকে নিজের বন্ধু রূপে গ্রহণ করে না। ভারতের বন্ধু হতে যেমন ইসলামপ্রীতি ছাড়তে হয়, তেমনি ভারতের এজেন্ডাকেও ষোল আনা গ্রহণ করতে হয়। এখানে আপোষ চলে না। ফলে বিএনপির নেতাদের মুখে যতদিন বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ধ্বনিত হবে ততদিন ভারতের কাছে প্রিয় হওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব। এমন কি অসম্ভব পাশ্চাত্যের দেশগুলির কাছেও। পাকিস্তান আমলে ভারতের কাছে প্রিয় হওয়ার খাতিরে তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতাদের দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বিদায় দিয়ে আওয়ামী লীগ হতে হয়েছে।

 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতীয় এজেন্ডা

ভারতের এজেন্ডার কাছে শেখ হাসিনার আত্মসমর্পণটি কোন গোপন বিষয় নয়। সে আত্মসমর্পণের কারণেই কাশ্মীরে ভারতীয় অধিকৃতি, গণহত্যা, নারী ধর্ষণ নিয়ে শেখ হাসিনার মনে কোন ক্ষোভ বা অভিযোগ নাই। কাশ্মীরীদের স্বাধীনতার লড়াইকে তিনি স্বাধীনতার লড়াই বলতেও রাজী নন। ভারতে শক্তিহানীকে তিনি তার নিজের শক্তিহানী মনে করেন। বরং আনন্দ বাড়ে মুসলিমের শক্তিহানীতে। ফলে তাঁর কাছে স্বাধীনতার লড়াই তো সেটি যা পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীন বেলুচিস্তান বা সিন্ধু বানাতে চায়। তাই কাশ্মীর প্রসঙ্গে ভারতের আগ্রসী শাসক চক্রের মুখে যে বুলি, অবিকল সেটিই ধ্বনিত হয় হাসিনার মুখে। নরেন্দ্র মোদীর সাথে সুর মিলিয়ে তিনিও কাশ্মীরী মুজাহিদদের সন্ত্রাসী বলে অভিহিত করে থাকেন। একারণেই কাশ্মীরে ৭ লাখ ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতি ও তাদের দখলদারি নিয়েও তাঁর কোন অভিযোগ নাই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির যে ক্ষোভ, সে ক্ষোভটুকুও হাসিনার নাই। কারণ মমতা ব্যানার্জি একজন স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক, কারো খুশি করতে তাকে রাজনীতি করতে হয় না। ফলে তার রাজনীতিতে মোদি থেকে ভিন্ন সুর তো থাকবেই। অথচ হাসিনার মুখে সেরূপ ভিন্ন সুর নাই। কারণ তাকে রাজনীতি করতে হয় ভারতের মুখের দিকে তাকিয়ে। এমন একটি ভারতমুখি সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে ভারত সরকার একাত্তরের ন্যায় আরেকটি যুদ্ধ করবে সেটিই কি স্বাভাবিক নয়?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে মাত্র দুটি পক্ষঃ একটি জনগণ, অপরটি ভারত। একই সাথে দুই নৌকায় পা রাখা যেমন অসম্ভব, তেমনি অসম্ভব হলো এরূপ বিপরীতমুখী দুটি পক্ষকে খুশি করা। জনগণকে পক্ষে টানতে  গিয়ে বিএনপি ভারতকে হারিয়েছে। জনগণের পক্ষ নেয়ার অর্থ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস, অনুভূতি ও সংস্কৃতিকে রাজনীতিতে গুরুত্ব দেয়া। জনগণের চেতনায় যেহেতু মজলুম কাশ্মীরী, ফিলিস্তিনী, রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রতি গভীর বেদনাবোধ, ফলে জনগণকে পক্ষে টানতে হলে রাজনীতিতে তাদের পক্ষ নেয়ার বিষয়টি অনিবার্য কারণেই এসে যায়। কিন্তু ভারতকে পক্ষ টানতে হলে নিজ দলের রাজনীতিতে আপন করে নিতে হয় সেদেশের মুসলিম নিধন, মসজিদ ধ্বংস, মুসলিম নারী ধর্ষণ ও গরু গোশতো খাওয়ার কারণে মুসলিমদের পিটিয়ে হত্যার ন্যায় নৃশংস বর্বরতাকে। শুধু তাই নয়। নিজ দেশে ইসলাম ও মুসলিমের বিরুদ্ধে ভারতীয় মডেলের নৃশংস বর্বরতা প্রয়োগ করে শিষ্যত্বের প্রমাণও দিতে হয়। এজন্যই হাসিনার রাজনীতিতে অনিবার্য রূপে দেখা দেয় শাপলা চত্ত্বরের উলামা হত্যাকান্ড, পিলখানার সেনা-অফিসার খুন, জামায়াত নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলানো, বিএনপি নেতাদের গুম এবং ইসলামি টিভি চ্যালেনের নিষিদ্ধকরণের ন্যায় নানারূপ নাশকতা। এরূপ নাশকতা দিল্লির শাসক মহলে শেখ হাসিনার কদর যে বিপুল ভাবে বাড়িয়েছে -সে প্রমাণ তো প্রচুর। ভারতের সামনে হাসিনার বিকল্প একমাত্র হাসিনাই। তার চেয়ে উত্তম বিকল্প যে নেই ভারতের শাসক মহল সেটি বুঝে। ক্ষমতায় থাকতে হলে এছাড়া ভিন্ন রাস্তা নাই শেখ হাসিনাও সেটি বুঝে। তাই তাঁর রাজনীতি ইসলাম ও মুসলিম বিনাশী নৃশংসতা যে দিন দিন আরো প্রকটতর হবে -তা নিয়ে কি আদৌ সন্দেহ আছে?

বাংলাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার রাজনীতিকে ভারত সমর্থণ দিবে সেটি কি ভাবা যায়? ভারতের সমর্থণ পেতে বরং অপরিহার্য হলো শুধু ইসলাম থেকে নয়, বাংলাদেশের জনগণ থেকে দূরে সরা। সে সাথে ইসলামের পক্ষের শক্তির নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া। ইসলামের বিপক্ষে যাদের অবস্থানটি সবচেয়ে কঠোর তারাই ভারতের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। ইসলামপন্থিদের সাথে জোট বাঁধার  কারণে ভারতের কাছে চক্ষশূল হয়েছে বিএনপি ও তার নেত্রী খালেদা জিয়া। মহিলাদের পর্দা না করা বা মাথায় কাপড় না দেয়াটি মহান আল্লাহতায়ালার বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। যার মধ্যে সামান্যতম ঈমান আছে, সে এ পথে নামে না। বিদ্রোহের সে ঝান্ডা উড়িয়ে খালেদা জিয়া ধর্মভীরু মুসলিমদের মনকে লাগাতর আহত করলেও ইসলামের দুষমনদের কাছে কি প্রিয় হতে পেরেছেন? কারণ, ভারত শুধু খালেদা জিয়ার নগ্ন মাথার বিদ্রোহে খুশি নয়। দেখতে চায়, মুসলিম ও ইসলামের বিরুদ্ধে তার পক্ষ থেকে নৃশংস নাশকতা। শেখ হাসিনা ও তার পরামর্শদাতাগণ ভারতের সে অভিলাষটি ষোল আনা বুঝে। এজন্যই শেখ হাসিনার রাজনীতি খালেদা জিয়া থেকে ভিন্ন। তার রাজনীতির এজেন্ডা ইসলামের পক্ষের শক্তিকে শুধু রাজনীতির ময়দান থেকে নির্মূল করা নয়; বরং রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও জনগণের চেতনার অঙ্গণ থেকে ইসলামি চেতনাকে বিলুপ্ত করা। ভারতকে খুশি করার এটিই মোক্ষম উপায়। একারণেই হাসিনা সরকার শুধু ইসলামি টিভি চ্যানেল গুলোকেই বন্ধ করেনি, স্কুল-কলেজের সিলেবাস থেকে বাদ দিয়েছে ইসলাম ও মুসলিম ইতিহাসের শিক্ষাণীয় বিষয়গুলো। জেল ঢুকিয়েছে যেমন দেশের প্রসিদ্ধ তাফসিরকারকদের, তেমনি ঘরে ঘরে গিয়ে পুলিশ বাজেয়াপ্ত করছে জিহাদ বিষয়ক বই। অথচ জিহাদ ছাড়া কি ইসলাম বাঁচে? জিহাদ তো ইসলামকে বাঁচানো ও বিজয়ী করার লড়াই। ইসলাম কি স্রেফ নামায-রোযা, হজ-যাকাত ও দোয়া-দরুদ? ইসলামের অবিচ্ছেদ্দ অঙ্গ হলো শরিয়ত, হদুদ, খেলাফত, জিহাদ, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য এবং শুরা ভিত্তিক শাসন। ইসলাম বাঁচাতে হলে তো এগুলিকেও অবশ্যই বাঁচাতে হয়। এবং ইসলাম বাঁচানোর সে লড়াইয়ে মুসলিমের জীবনে জিহাদও অনিবার্য রূপে হাজির হয়। বস্তুতঃ ঈমানের মূল পরীক্ষাটি তো হয় লড়াইয়ের সে ময়দানে। তাছাড়া জিহাদের চেতনা না থাকলে কাফেরদের হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চেতনাই বা গড়ে উঠবে কেমনে? কাফের হামলা থেকে বাঁচতে হলে জিহাদের সে প্রস্তুতিটি তো জরুরী। একমাত্র শয়তানই মুসলিমদের জিহাদহীন এবং জিহাদে প্রস্তুতিহীন দেখে খুশি হতে পারে। কারণ তাতে তার অনুসারিদের বিজয়টি বিজয়টি হয়। তবে শেখ হাসিনার এজেন্ডা শুধু ইসলাম বিরোধী নাশকতাতেই থেমে যায়নি। তার নাশকতার পথটি আরো নৃশংস। ইংরেজদের খুশি করতে মীর জাফর যেমন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও অন্যান্য ইংরেজ-বিরোধীদের নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল। ভারতকে খুশি করতে শেখ হাসিনাও একই পথ ধরেছে। ফলে তাঁর হাতে গুম, খুন ও ফাঁসিতে ঝুলছে একের পর ভারত বিরোধীগণ।

তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত প্রেম শুধু শেখ হাসিনা ও তার দলের একার বিষয় নয়। শিক্ষা-সংস্কৃতি, পত্র-পত্রিকা ও টিভি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সে রোগই বছরের বছর ধরে দেশময় ছড়ানো হয়েছে। তাছাড়া হাসিনার রাজনীতি তো মুজিবের রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা। এবং রাজনীতির যে অঙ্গণে গুরুত্ব পায় মুজিবের চেতনা, বাকশালী স্বৈরাচার তো সেখানে থাকবেই। সে সাথে থাকে ভারতপ্রেমও। কারণ হিটলার থেকে তাঁর ফ্যাসিবাদকে যেমন আলাদা করা যায় না, মুজিব থেকেও তেমনি আলাদা করা যায় না তাঁর বাকশালী স্বৈরাচার ও ভারতের প্রতি তাঁর গভীর আনুগত্য। সে আনুগত্যের সাথে আসে আগরতলা ষড়যন্ত্রের ঐতিহ্যও। মুজিবের রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো একাত্তর। সে একাত্তরের সবটুকু জুড়ে হলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপের ইতিহাস। সে হস্তক্ষেপ ছাড়া কি বাংলাদেশ সৃষ্টি হতো? মুক্তি বাহিনী সৃষ্টি না হলেও চলতো, কিন্তু ভারতের হস্তক্ষেপটি ছিল অপরিহার্য। তাই বাংলাদেশ সৃষ্টিতে মুক্তিবাহিনীকে একটি জেলা, একটি মহকুমা, এমন কি একটি থানাকেও স্বাধীন করতে হয়নি। পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পুরা কাজটি করেছে ভারত তার নিজ পরিকল্পনা, নিজ অর্থ ও নিজ সেনাবাহিনী দিয়ে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে অধিকৃত ও লুণ্ঠিত হয়েছিল সমগ্র দেশ। ভারতের এরূপ রাজনৈতিক ও সামরিক অধিকৃতিই তো একাত্তরের চেতনার মূল কথা। একাত্তরের চেতনাধারীগণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক, আদর্শিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গণে ভারতের সে অধিকৃতিটি আজও চায়। ভারতে বিলীন না হয়েও ভারতের অধিকৃতি নিয়ে বাঁচার সে এক গোলামী চেতনা। কারণ তারা চায়, রাজনৈতিক, আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণে ইসলামকে বাদ দিয়ে বাঁচতে। কিন্তু তারা জানে, ভারতের লাগাতর উপস্থিতি ছাড়া ইসলামী চেতনাকে এ দেশে যে বাদ দেয়া অসম্ভব। সেটি চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল ১৯৪৭ সালে।  এবং আজও সেটিই ব্যস্তবতা। এমন এক প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ য়ে ভারতের বিজয় ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। ভারত সেটি বুঝে। সে ধারণাটি তাদের মনে আরো বদ্ধমূল হয় মুজিবের মৃত্যুতে ঢাকার রাস্তায় মানুষের আনন্দ মিছিল দেখে। শেখ হাসিনার প্রতি ভারতে পূর্ণ সমর্থণের মূল কারণ তো একাত্তরের সে লিগ্যাসিকে বাঁচিয়ে রাখার অনিবার্য প্রয়োজনে।

বাংলাদেশের সেক্যুলার রাজনীতিতে মুজিবের চেতনার প্রতিষ্ঠা পাওয়ায় শুধু ভারতপ্রেম নয়, স্বৈরাচার-প্রেমও মহামারিতে রূপ নিয়েছে। তাছাড়া যে রাজনীতিতে মুজিবের চেতনা থাকে, তাতে বাকশালী স্বৈরাচার থাকবে না সেটি কি ভাবা যায়? তাই যেখানে মুজিবপ্রেম, তার গভীরে থাকে গভীর স্বৈরাচারপ্রেমও। তখন মারা পড়ে গণতন্ত্র। স্বৈরাচার-প্রেমের সে মহামারির কারণে দুর্বৃত্ত এরশাদও দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সাবেক বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে অপসারণ করে ক্ষমতা দখলের সাহস পায়। যে কোন দেশের কোন সভ্য মানুষের কাছে সামরিক জান্তার হাতে গণতন্ত্র হত্যার এরূপ নাশকতাটি গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা নয়। অথচ শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাদের কাছে সেটি শুধু গ্রহণযোগ্যই হয়নি, উৎসবযোগ্য গণ্য হয়েছিল। গণতন্ত্র বলতে আওয়ামী লীগের নেতাগণ কি বুঝেনসেটিই সেদিন নগ্ন ভাবে প্রকাশ পেয়েছিল।

 

স্ট্রাটেজী কালচারাল ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের

ভারতমুখী রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক এজেন্ডা ছিল শেখ মুজিবেরও। তার সে এজেন্ডায় ইসলাম ও মুসলিমের কোন স্থান ছিল না। কিন্তু তার জীবনে হঠাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট এসে পড়ায় সে এজেন্ডা পূরণের সুযোগ তিনি পাননি। সে অভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে এখন অগ্রসর হচ্ছে শেখ হাসিনাকে। এবং সেটি বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতির দিকে তাকালে সহজেই চোখে পড়ে। ভারত জানে, হিন্দুদের থেকে ভিন্নতর ও প্রবলতর একটি সাংস্কৃতিক পরিচয়ের কারণেই ১৯৪৭ সালে বাঙালি মুসলিমগণ স্বেচ্ছায় পাকিস্তানে অঙ্গিভূত হয়েছিল। সে ভিন্ন পরিচয়টি হলো ইসলামী চেতনা ও সে চেতনা নির্ভর মুসলিম সংস্কৃতি। জনগণের চেতনায় ইসলাম বেঁচে থাকার কারণেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলা ১৯৪৭ সালে ভারতে বিলীন না হয়ে পৃথক মানচিত্র পায়। একই কারণে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলেও স্বাধীন বাংলাদেশের পরিচয় নিয়ে এখনো বেঁচে আছে। বাঙালী মুসলিমদের স্বাধীন পরিচয় নিয়ে এরূপ বেঁচে থাকাটিই ভারতের কাছে চক্ষশূল। কারণ, তারা তো গড়তে চায় এক দেহে লীন অখণ্ড ভারত এবং সে ভারতের হিন্দুদের একক আধিপত্য। নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপীর পশ্চিম বাংলার প্রাদেশিক সভাপতি যখন প্রকাশ্যে হুংকার দেন, দুই বাংলা আবার এক হবে, তখন কি বুঝতে বাঁকি  থাকে, বাংলাদেশের পৃথক অস্তিত্ব তাদের কাছে কতটা অসহ্য?

অখণ্ড ভারত নির্মাণের পথে বাংলাদেশের মুসলিমদের মাঝে ইসলামী চেতনা ও মুসলিম সংস্কৃতি হলো বড় বাঁধা। সে বাঁধাটি নির্মূল করার লক্ষ্যেই ভারতের ও ভারতসেবী বাঙালী রাজনীতির মূল এজেন্ডা হলো, ইসলামের চেতনা ও মুসলিম সংস্কৃতির বিনাশ। ১৯৭১য়ে পূর্ব  পাকিস্তানের পরিচিতিটি বিলুপ্ত হলেও ইসলামি চেতনা ও মুসলিম সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়নি। তাই প্রয়োজন পড়েছে সরকারি অর্থে সুদুর প্রসারি কালচারাল ইঞ্জিনীয়ারিং। নব্য সংস্কৃতির সে ভারতীয় প্রকল্পে ইসলামের কোন স্থান নেই। বরং সেখানে জয়জয়াকার স্রেফ হিন্দু সংস্কৃতির। ফলে সরকারি উদ্যোগে সারা দেশ জুড়ে স্কুল, কলেজ ও রাজপথে শুরু হয়েছে ছবি পূজা, প্রদীপ পূজা, শাপ, পেঁচা, গরু-মহিষ, হুনুমান ইত্যাদি জীবজন্তুর ছবি নিয়ে বিশাল মিছিল। এভাবে সনাতন পৌত্তলিক জাহিলিয়াতকে বাঙালীর জাতীয় সংস্কৃতি রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়া হচ্ছে। স্বৈর-শাসকের হাতে অধিকৃত হওয়ার বিপদটি তাই শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার হারানোর নয়, বরং সেটি নিজ ধর্ম ও নিজ সংস্কৃতি নিয়ে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রেও।

তাই যে দেশে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা পায়, সে দেশ ব্যর্থ হয় সভ্যদেশ রূপে বেড়ে উঠায়। তখন চরম অবক্ষয় শুরু হয় মূল্যবোধের। তাতে ইসলামের আদি রূপটি যেমন বাঁচে না, তেমনি বাঁচে না সত্য, সততা, ন্যায়নীতি ও সুস্থ্য সংস্কৃতি। এমন একটি নৈতীক অবক্ষয় ও অসভ্যতার কারণেই বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশের মাঝে দুর্নীতিতে বাংলাদেশ প্রথম হয়েছে। এমন দেশে প্রবলতর হয় স্বৈরাচারি শাসকের স্বেচ্ছাচার ও সোসাল ইঞ্জিনীয়ারিং। তখন শুরু হয় ইসলাম থেকে দ্রুত দূরে সরা। যুগে যুগে তাই ইসলামের প্রতিষ্ঠা রুখতে শয়তানের সবচেয়ে বিশ্বস্থ্য সহচর হলো স্বৈরাচারি শাসক ও তার সহচরগণ। ভারতের শাসক চক্রটি এজন্যই শেখে হাসিনার উপর এতটা প্রসন্ন। আর এতে কাশ্মীরের মুসলিমদের ন্যায় দ্রুত বিপদ বাড়ছে বাংলাদেশের মুসলিমদের। বাংলাদেশ পরিণত হচ্ছে আরেক কাশ্মীরে। তবে ভারতের জন্য বাড়তি সুবিধাটি হলো, কাশ্মীরের ন্যায় বাংলাদেশে ভারতের ৭ লাখ সৈন্য মোতায়েন করতে হয়নি। ভারতীয় সৈন্যদের সে কাজটি করছে বাংলাদেশের ভারতবান্ধব সরকার, পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী। তাদের কারণেই শাপলা চত্ত্বরে হিফাজতে ইসলামের অগণিত নিরস্ত্র মুসল্লিদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় কোন ভারতীয় সৈন্যদের নামতে হয়নি। স্বরাষ্ট্র দফতরের হিসাব মতে ২০১৩ সালের ৫ মের রাতে নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৫৫ হাজার গোলবারুদ ব্যবহৃত হয়েছে। ময়দানে নামানো হয়েছিল পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর ৭ হাজার ৫৮৫ জন সেপাহীকে।

প্রশ্ন হলো, ২৩ বছরের পাকিস্তানী আমলে কখনোই কি এতবড় বিশাল সশস্ত্র বাহিনীকে নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে নামানো হয়েছে? এরূপ নৃশংসতা কি সুলতানী ও মোঘল আমলে হয়েছে? সরকার সে নৃশংস হত্যাকাণ্ড গোপন করার চেষ্টা করেছে। তবে সরকারের হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি বুঝা যায় শাপলা চত্ত্বরে ৭ হাজার ৫৮৫ জন সেপাহীর উপস্থিতি দেখে। সে রাতে সেখানে তারা রথ দেখতে হাজির হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, সে রাতে দুই শতাধিক মানুষ লাশ হয়েছে এবং আড়াই হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছে। নিখোঁজদের অনেকেই যে লাশ হয়েছে তা নিয়ে কি সন্দেহ চলে? লাশ ময়লার গাড়িতে তুলে গায়েব করা হয়েছে। কোন সভ্যদেশে কি মৃতদের সাথে ‌এরূপ আচরণ হয়? স্বৈর শাসনের এটি এক অসভ্যতর অধ্যায়। হিফাজতে ইসলামের প্রধান মাওলানা শফি এটিকে গণহত্যা বলে অভিহিত করেছেন। এক রাতে এত অধীক সংখ্যক মুসলিমের নৃশংস হত্যাকাণ্ড কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর বা অন্য কোন শহরে এ অবধি হয়নি। বস্তুতঃ এরূপ বীভৎ অসভ্যতাই হলো হাসিনার স্বৈর শাসনের মূল অবদান। উন্নয়নের মিথ্যা কোরাস গেয়ে কি এরূপ নৃশংসতার বেদনা লাঘব করা যায়? গড়ে উঠে কি সভ্য দেশ? ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রেয়ারি পুলিশের গুলিতে তিন মারা গিয়েছিল। তা নিয়ে আজও আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙ্গানো একুশে ফেব্রেয়ারী, আমি কি ভূলিতে পারি? গাওয়া হয়। কিন্তু ২০১৩ সালের ৫ই মের রাতে সে নৃশংস গণহত্যা হলো বাংলার মুসলিমগণ সেটি ভূলে কি করে? অথচ আজ সেটিও ভূলিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এবং সেটি স্বৈর শাসনের অসভ্যতাকে বাঁচানোর স্বার্থে। ২০/০৫/২০১৮ Tweet:@drfmkamal; facebook.com/firozkamal

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *