বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ এবং নাশকতা ইসলামের বিরুদ্ধে
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on March 17, 2019
- Bangla Articles, বাংলাদেশ
- No Comments.
নৃশংস নাশকতার রা্জনীতি
ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী কোয়ালিশনের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধটি নিছক সামরিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতীক নয়। সমগ্র মুসলিম বিশ্বজুড়ে সে যুদ্ধটি অতি প্রবল ভাবে হচ্ছে সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক ময়দানে। সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক যুদ্ধের তেমনি একটি অতি রক্তাত্ব রণাঙ্গণ হলো বাংলাদেশ। ইসলামবিরোধী পাশ্চাত্যের সে কোয়ালিশনে যোগ দিয়েছে আরেক আগ্রাসী দেশ ও মুসলিমদের অতি পরিচিত শত্রু ভারত। শত্রুপক্ষের আন্তর্জাতিক কোয়ালিশন আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া বা ফিলিস্তিনের মুসলিমদের বিরুদ্ধে আজ যা কিছু করছে, ভারতে অবিকল সেটিই ঘটে আসছে বিগত ৬০ বছরের বেশী কাল ধরে। সেটি যেমন অধিকৃত কাশ্মিরে, তেমনি কাশ্মিরের বাইরে ভারতীয় জিম্মি মুসলিমদের বিরুদ্ধে। একাত্তরের পর সে যুদ্ধই প্রবল ভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে বাংলাদেশে। কাশ্মিরে রক্ত ঝরছে মুসলিমদের এবং কেড়ে নেয়া হয়েছে তাদের স্বাধীনতা, বাংলাদেশেও রক্ত ঝরছে তাদের যারা ইসলামের পক্ষে কথা বলে। এবং কেড়ে নেয়া হয়েছে তাদের স্বাধীনতাও।
ভারতীয় বর্ণহিন্দুদের থেকে গরু-বাছুর, সাপ-শকুনেরাও পূজা পায়। নিরাপত্তাও পায়। কিন্তু তাদের কাছে ঘৃণ্য ও হত্যাযোগ্য গণ্য হয় মুসলিম নরনারী ও শিশু। সে অভিন্ন ঘৃণা নিয়ে মুসলিমদের ঘরে আগুণও দেয়া হয়। তাই থলিতে বা ঘরে স্রেফ গরুর গোশত রাখার সন্দেহে সে দেশে দিবালোকে পুলিশের সামনে অতি নৃশংস ভাবে মুসলিমদের হত্যা করা হচ্ছে। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে একই রূপ ধুমধাম করে অযোধ্যার বাবরী মসজিদও গুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। সে অপরাধ রুখতে যেমন পুলিশ কোনরূপ ব্যবস্থা নেয়নি। তেমনি মসজিদ গুড়িয়ে কাউকে শাস্তিও দেয়নি। ভারতীয় সরকার ও তার পুলিশের কাছে অপরাধের সংজ্ঞা যে ভিন্ন, সেটি কি এরপরও বুঝতে বাঁকি থাকে? কোন মুসলিম খুন হলে, মুসলিমের কোন ঘর জ্বালিয়ে দিলে বা কোন মসজিদ গুঁড়িয়ে দিলে ভারেত যে সেটি অপরাধ গণ্য হয় না -সেটি মুসলিম বিরোধী এত দাঙ্গা ও মুসলিমের এতো ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার পর গোপন থাকার কথা নয়। গরু বাঁচানোর লক্ষ্যে হাজার হাজার হিন্দু রাস্তায় নামলেও সে গরজ মুসলিমদের জান বাঁচাবার বেলায় নাই। বরং উল্টো, যারা গরু বাঁচাতে নেমেছ তারাই হত্যা করছে নিরীহ মুসলিমদের। এক্ষেত্রে সরকার ও সরকারি দলের প্রশ্রয়ও কি কম?
চোর-ডাকাত ও খুনিদের সাথে গলাগলি করে নিজ ঘরের বাসিন্দাদের চরিত্রে সাধুতা আনা যায় না। সভ্য হতে হলে তাই অসভ্যদের থেকে দূরে থাকতে হয়। এটিই ইসলামের শিক্ষা। কিন্তু বাংলাদেশী সরকারে পরম বন্ধু ও অভিভাবক হলো দিল্লির নরেন্দ্র মোদীর সরকার। অথচ নরেন্দ্র মোদীর হাত গুজরাতের মুসলিম রক্তে রঞ্জিত। এ অপরধের কারণে প্রেসিডেন্ট ওবামা যুক্তরাষ্ট্রে তারা প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিলেন। তিনি যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী তখন ২ হাজারের বেশী মুসলিম নারী, পুরুষ ও শিশুকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। শত শত মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। ধর্ষণ শেষে অনেক মহিলাকে আগুনে ফেলা হয়েছিল। সে জঘন্য অপরাধ কর্ম দমনে মোদী যেমন উদ্যোগ নেননি, তেমনি অপরাধীদের শাস্তিও দেননি। সে অপরাধী মোদীই এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ফলে তার ন্যায় কোটি কোটি মোদী এখন ভারত জুড়ে ছেয়ে গেছে। এতে মুসলিম বিনাশী নৃশংসতা বেড়েছে সমগ্র ভারত জুড়ে। কাশ্মির পরিণত হয়েছে বধ্যভূমিতে। এরূপ ভয়ানক চেতনা নিয়ে মানবরূপী এসব দানবগণ শুধু ভারত বা কাশ্মিরে নয়, খোদ বাংলাদেশের রাজনীতিতেও জেঁকে বসেছে। তবে বাংলাদেশের রণাঙ্গনে তাদের বাড়তি সুবিধাটি হলো তারা দেশটিতে একা নয়; বরং সাথে পেয়েছে অভিন্ন চেতনার বিপুল সংখ্যক সহযোদ্ধা। ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এসব ভারতসেবী বাংলাদেশীগণ ভারতীয়দের চেয়েও ভারতীয়; এবং হিন্দুদের চেয়েও অধিক পূজারী হলো হিন্দু সংস্কৃতির। তাই মঙ্গল প্রদীপের পূজা যতটা ঢাকায় হয় এবং সেখানে লক্ষ লক্ষ বেদীমূলে যত ফুল দেয়া হয় তা কলকাতা বা দিল্লিতে হয় না। ভারতীয় স্বার্থের পাহারাদার রূপে বাংলাদেশের মাটিতে তাদের অবস্থান হলো রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সাংস্কৃতিক ক্যাডার, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিক, আইনজীবী, বিচারপতি, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা রূপে। তাদের উপর অর্পিত মূল দায়িত্ব হলো, বাংলার মাটিতে শরিয়ত, হুদুদ ও কোরআনী নীতির বাস্তবায়নের ন্যায় ইসলামের মৌল বিষয়গুলিকে পরাজিত রাখা। লক্ষ্য: বাংলাদেশী মুসলিমদের পূর্ণ মুসলিম রূপে বেড়ে উঠতে না দেয়া। সে সাথে বাংলাদেশের রাজনীতি, প্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও শিক্ষা-সংস্কৃতির উপর ভারতীয় দখলদারীকে বহাল রাখা।
ভারতীয়দের সাহায্যে ও প্রশ্রয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতসেবীদের সফলতাটি বিশাল। সেটি যেমন একাত্তরে, তেমনি আজও। মুসলিমদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই তারা বাংলার সমগ্র মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে। একাত্তরে লক্ষাধিক বিহারী মুসলিমদের এরা বিনা বিচারে হত্যা করেছে। এখন সে অভিন্ন হত্যাকাণ্ড চলছে খোদ বাঙালী মুসলিমদের বিরুদ্ধে। তাই ২০১৩ সালে ঢাকার শাপলা চত্ত্বরে নিরস্ত্র মুসল্লীদের জমায়েতের উপর কামান দেগে শত শত নিরীহ মানুষ নিমিষের মধ্যে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর বিগত ৭০ বছরে ভারতের বিভিন্ন শহরে অনুষ্ঠিত সকল মুসলিম বিরোধী দাঙ্গাতে যত মুসলিম নরনারীকে হত্যা করা হয়েছে ভারতসেবী বাঙালীগণ একমাত্র একাত্তরেই তার চেয়ে বেশী মুসলিমকে বাংলাদেশে হত্যা করেছে। শুধু অবাঙালীদের নয়, ভারতবিরোধী হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ বাঙালী মুসলিমদেরও তারা হত্যা করা হয়েছে। বিগত ৭০ বছরে অধিকৃত কাশ্মীরে যুদ্ধরত ৬ লাখ ভারতীয় সৈন্যও এত মুসলিম হত্যা করতে পারিনি যা ভারতসেবী বাঙালীগণ মাত্র এক বছরে হত্যা করেছে। এজন্যই তাদের প্রতি ভারত এত প্রসন্ন এবং তাদের ক্ষমতায় রাখার জন্য দেশটির এত বিনিয়োগ।
একাত্তরে বিহারী মুসলিমগণ অপরাধী গণ্য হয়েছে এ কারণে যে, নিজেদের ঘর-বাড়ি ভারতে ফেলে ১৯৪৭য়ে তারা পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল এবং একাত্তরে দেশটির ভাঙ্গার কাজে তারা ভারতের অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেনি। বরং পাকিস্তানকে নিজেদের দেশ ভেবে দেশটির সংহতি ও দীর্ঘায়ু কামনা করেছে। বিহারীদের সবচেয়ে বড় অপরাধ, ভারতসেবী বাঙালীদের ন্যায় তারা ভারতীয় আধিপত্যের সেবাদাস হতে পারেনি। তবে সেরূপ না করার পিছনে প্রচুর কারণও ছিল। ভারতে জন্ম নেয়ার কারণে বিষপূর্ণ হিন্দু মানসিকতার সাথে তাদের পরিচিতিটি ছিল যে কোন বাংলাদেশীদের চেয়ে অতি গভীর। তাছাড়া এ অপরাধটি কি শুধু বিহারীদের? লক্ষ লক্ষ বাঙালী মুসলিমও তো সেদিন অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। তাদের অনেকে ভারতীয় বাহিনী ও তার দোসরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছিল। একাত্তরে কোন একজন শিক্ষিত আলেম পাকিস্তান ভাঙাকে সমর্থণ করেছে -সে প্রমাণ কি আছে? প্রতিটি আলেম ও ইসলামপন্থি এজন্যই ভারতসেবীদের কাছে আজও রাজাকার। অথচ সে কারণে বিহারীদের বাঁচতে দেয়া হয়নি।
একাত্তর নিয়ে ভারতীয়দের সবচেয়ে বড় উল্লাসের কারণ শুধু এ নয় যে, তারা পাকিস্তান ভাঙ্গতে পেরেছে। বরং এজন্য যে, খোদ মুসলিম ভূমিতে লক্ষাধিক মুসলিমকে হত্যা করতে পেরেছে। ভারতীয় ভূমিতে এত মুসলিম হিন্দুদের হাতে নিহত হলে সমগ্র মুসলিম বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ উঠতো, যেমনিট মায়ানমারের বিরুদ্ধে হচ্ছে। খুনিরা এজন্যই খুনখারাবীর জন্য নিজের বসত ভিটার বাইরে বধ্যভূমি বেছে নেয়। মার্কিনীদের কাছে তেমন বধ্যভূমি হলো আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেন। ভারতীয়গণ বাংলাদেশকে তেমনি একটি বধ্যভূমি রূপে বেছে নিয়েছিল একাত্তরে। বাংলাদেশের মাটিতে সে সুযোগটি ভারত ধরে রাখতে চায়। নইলে পাকিস্তানের ন্যায় পূর্ব সীমান্তেও আরেক পাকিস্তান খাড়া হবে সে ভীতি তাদের মনে অতি প্রবল। সে জন্যই বাংলাদেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে ভারতীয়দের শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ। রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে মায়ানমারের বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের আচরণটি অতিশয় নৃশংস ও ভয়াবহ। হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের ঘরে তারা আগুণ দিয়েছে। বহু হাজারকে তারা হত্যা করেছে। শত শথ রোহিঙ্গা মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু একাত্তরে তার চেয়ে বহুগুণ বেশী নৃশংস বর্বরতা হয়েছে বিহারী মুসলমানদের বিরুদ্ধে। একই রূপ হত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠন ও গৃহ আগুনের প্রকোপে পড়েছে বিহারীগণ। এবং সেটি ভারতসেবী বাঙালীদের হাতে। দখলদার ভারতীয় সেনাবাহিনী সে বর্বরতা থামাতে কোন উদ্যোগ নেয়নি। মায়ানমারে মুসলমানের ঘরবাড়ী জ্বালানো হলেও এ বিধান কখনোই প্রয়োগ করা হয়নি যে, মায়ানমারে কোন রোহিঙ্গা মুসলিমের ঘরবাড়ী ও দোকানপাঠের মালিক হওয়ার অধিকার নাই। ফলে কোন বৌদ্ধই রোহিঙ্গা মুসলিমের ঘরবাড়ি ও দোকান পাটের মালিকানা দাবি করেনি। অথচ সে নীতির প্রয়োগ করা হয়েছে বিহারী মুসলমানদের বিরুদ্ধে। তাদের থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে তাদের বসতবাড়ি, দোকানপাট ও ব্যবসা-বাণিজ্য। বিহারীদের তাদের নিজ ঘরবাড়ী থেকে উচ্ছেদ করে বস্তিতে পাঠানো হয়েছে। এবং তাদের ঘরবাড়ীর মালিক হয়েছে ভারতের সেবাদাসগণ। বাংলার সমগ্র ইতিহাসে কখনোই কি কোন জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে এমন অপরাধ হয়েছে? ১৯৪৭ সালে কি কোন হিন্দু পরিবারকে কি বস্তিতে বসানো হয়েছে? অথচ তারাতো পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাণপণে বিরোধীতা করেছিল?
রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার বিরুদ্ধে বহু বার্মিজ বুদ্ধিজীবী যে সোচ্চার –সে প্রমাণ অনেক। তারা বিদেশী টিভি চ্যানেলে এমন কি সেদেশের নেত্রী অঙ সাং সূচীর বিরুদ্ধেও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। কিন্ত বিহারী মুসলিমদের বিরুদ্ধে একাত্তরে যে বর্বর নৃশংসতা হলো তার বিরুদ্ধে কি কোন বাঙালী বুদ্ধিজীবী বা রাজনীতিবিদ প্রতিবাদী হয়ে রাস্তায় নেমেছে বা পত্রিকায় কোন বিবৃতি দিয়েছে? সে নৃশংসতা নিয়ে বিদেশের পত্র-পত্রিকায় বহু নিবন্ধ ছাপা হলেও ঢাকার কোন পত্রিকায় কি একটি নিবন্ধও ছাপা হয়েছে? ডাকাত পাড়ায় যেমন নৃশংস ডাকাতীর নিন্দা না হয়ে বরং তা নিয়ে প্রচণ্ড উল্লাস হয়, সেরূপ একটি অবস্থা ছিল বাংলাদেশের ভারতসেবীদের মহলে। বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের চেতনার ভূবন যে ভারতসেবীদের হাতে কতটা অধিকৃত ও মৃত -এ হলো তার নজির। একাত্তরে বিহারী মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারা বাঙালী নয়। এখন বাঙালী মুসলিমদের বেছে বেছে হত্যা করা হচ্ছে এ কারণে যে, তারা ভারতসেবী রাজনীতির সেবাদাস নয়। সে অপরাধে এমনকি ৫৭ জন বাঙালী সেনা অফিসারকে নিহত হতে হয়েছে। ভারতসেবী রাজনীতিকে বলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এবং সে চেতনার বিরুদ্ধে কথা বলা চিত্রিত হচ্ছে যুদ্ধাপরাধ বলে।
পাশের নেকড়ের হাতে কোন মানুষকে নিহত হতে দেখে পাশের নেকড়ে তাকে বাঁচাতে আগ্রহ দেখায় না। পারলে সে নেকড়েটিও সে নৃশংসতায় অংশ নেয়। সেরূপ আচরন মানবতাশূণ্য মনুষ্যরূপী দানবদেরও। তাই রোহিঙ্গাদের উপর প্রচণ্ড নৃশংসতা দেখে সুদূর তুরস্ক থেকে সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ত্রাণসামগ্রী নিয়ে মায়ানমারে ছুটে এসেছেন। মায়ানমারের সরকারের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীও। তিনিন জাহাজ-ভর্তি রিলিফও পাঠিয়েছেন। ছুটে এসেছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান। কিন্তু নিশ্চুপ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিশ্চুপ কাশ্মীরের হাজার হাজার মুসলিশ নরনারী ও শিশুকে নিহত ও আহত হতে দেখেও। অথচ প্রতিবেশী দেশে মুসলিমদের বাঁচাতে মহান আল্লাহতায়ালা জিহাদ ফরজ করেছেন। বলেছেন, “তোমাদের কি হলো যে, তোমরা যুদ্ধ করবে না আল্লাহর পথে এবং অসহায় নরনারী ও শিশুদের বাঁচাতে যারা বলছে, “হে আমাদের রব! যালিমদের অধিকৃত এই জনপদ থেকে আমাদের মুক্ত করুন, আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য অভিভাবক নিযুক্ত করুন এবং কাউকে আমাদের জন্য সাহায্যকারি রূপে প্রেরণ করুন।” –(সুরা নিসা, আয়াত ৭৫)। এটি এমন এক অর্পিত দায়িত্ববোধ যা এড়িয়ে যাওয়ার অর্থ মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা –যা ভয়ানাক কবিরা গুনাহ। তেমন দায়িত্ববোধে অত্যাচারি রাজা দাহিরেরর হাত থেকে অসহায় হিন্দু নরনারী ও শিশুদের বাঁচাতে সুদূর ইরাক থেকে মহম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুতে ছুটে এসেছিলেন। এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ লড়েছিলেন। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের উলামা সম্প্রদায়, ইসলামী দলসমুহের নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ মুসল্লীদের মাঝেই বা কতটুকু বেঁচে আছে সে ঈমান? কোথায় সে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম পালনের আগ্রহ?
স্ট্রাটেজী ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে
বিশ্ব-রাজনীতির অঙ্গণ থেকে সোভিয়েত রাশিয়ার বিদায়ের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেবেছিল, তাদের পথের কাঁটা এবার বুঝি দূর হলো। ভেবেছিল, আধিপত্য বিস্তৃত হবে এবার বিশ্বজুড়ে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে মুসলিমগণ। আফগানিস্তান ও ইরাকের মত দুইটি দেশ দখলে রাখতেই তাদের হিমশিম খেতে হচেছ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ন্যায় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ শেষ হতে ৫ বছর লেগেছিল। কিন্তু বিগত ১৭ বছর যুদ্ধ লড়েও মার্কিন নেতৃত্বাধীন ৪০টিরও বেশী দেশের কোয়ালিশ বাহিনী আফগানিস্তানে বিজয় আনতে পারিনি। বরং দ্রুত এগিয়ে চলেছে পরাজয়ের দিকে। পাশ্চাত্যের কাছে এখন এটি সুস্পষ্ট, আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিন, লেবানন, সোমালিয়ার মত ক্ষুদ্র দেশগুলো দখল করা এবং সেগুলোকে কন্ট্রোলে রাখার সামার্থ্য তাদের নেই। যে প্রতিরোধের মুখে তারা হারতে বসেছে সেটির মূল হাতিয়ার অত্যাধিক যুদ্ধাস্ত্র নয়, জনবল বা অর্থবলও নয়। বরং সেটি কোরআনী দর্শন ও ইসলামের সনাতন জিহাদী সংস্কৃতি। এ দর্শন ও সংস্কৃতিই মুসলমানের জন্য আত্মসমর্পণকে অসম্ভব ও অচিন্তনীয় করে তুলেছে। বরং হাজার হাজার যুবকেদর কাছে অতিশয় কাম্য গণ্য হচ্ছে আগ্রাসী শত্রুর বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াই ও শাহাদত। এমন চেতনা এবং এমন সংস্কৃতির বলেই এক কালের মুসলমানেরা রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের ন্যায় দুটি বিশ্বশক্তিকে পরাজিত করেছিল। এ যুগেও তারা বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র ও বিশ্বশক্তি রাশিয়াকে পরাজিত করেছে। এবং এখন গলা চেপে ধরেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। আফগান মোজাহিদদের জিহাদ তাই পাল্টে দিচ্ছে বিশ্বরাজনীতির সমীকরণ। কামান, বোমা ও যুদ্ধবিমানের বলে গণহত্যা চালানো যায়। নগর-বন্দরও ধ্বংস করা যায়। কিন্তু সে কামানে বা গোলায় কি দর্শন ও সংস্কৃতির বিনাশও সম্ভব? বরং তাদের আগ্রাসন ও গণহত্যায় প্রতিরোধের সে দর্শন ও সংস্কৃতিই দিন দিন আরো বলবান হচ্ছে। কোন মার্কিনীকে রণাঙ্গণে রাখতে মাথাপিছু প্রায় এক মিলিয়ন তথা ১০ লাখ ডলার খরচ হয়। অথচ মুসলমানরা হাজির হচ্ছে নিজ খরচে। তারা শুধু স্বেচ্ছাই অর্থই দিচ্ছে না, প্রাণও দিচ্ছে।
অবস্থা বেগতিক দেখে পাশ্চাত্য এখন ভিন্ন স্ট্রাটেজী নিয়েছে। সেটি শুধু গণহত্যা নয়। নিছক নগর-বন্দর, ঘরবাড়ী এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের বিনাশও নয়। বরং সেটি হলো ইসলামের কোরআনী দর্শন ও সংস্কৃতির ধ্বংস। তাই শুরু করেছে প্রকাণ্ড আকারের সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। নতুন এ স্ট্রাটেজীর আলোকে ইরাক ও আফগানিস্তানে তারা শুধু মানুষ হত্যাই করছে না, ঈমান হত্যাতে তৎপর হয়েছে। এবং সেটি শুধু আফগানিস্তান ও ইরাকে সীমিত নয়। বাংলাদেশের ন্যায় প্রতিটি মুসলিম দেশই এখন একই রূপ সাংস্কৃতিক যুদ্ধের শিকার। তবে বাংলাদেশ তাদের অন্যতম টার্গেট হওয়ার কারণ, দেশটিতে ১৬ কোটি মুসলমানের ব্সবাস। তেল, গ্যাস বা অন্য কোন খনিজ সম্পদের চেয়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার ফ্যাক্টরটিই তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তেল, গ্যাস যোদ্ধা বা বোমায় পরিণত হয়না, কিন্তু মানুষ হয়। তাই বাংলাদেশীগণ না চাইলেও সাম্রাজ্যবাদীদের এ আগ্রাসনের টার্গেট হওযা থেকে বাঁচার উপার নাই। শত্রুর লক্ষ্য এখন মুসলমানদের ঈমানকে হত্যা করা। ফলে মহাসংকটে এবার শুধু দুনিয়ার জীবন নয়, আখেরাতের জীবনও। কারণ এ যুদ্ধে তারা বিজয়ী হলে অসম্ভব হবে ঈমান নিয়ে বাঁচা।
লক্ষ্য: কোরআন থেকে দূরে সরানো
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের স্ট্রাটেজী তাই মুসলমানদের জীবন থেকে জিহাদের সংস্কৃতি বিলুপ্ত করা। এবং ভূলিয়ে দেওয়া শরিয়ত, হদুদ, শুরা, খেফাফত, জিহাদ, মুসলিম ঐক্যের ন্যায় ইসলামি মৌল বিষয়গুলোকে। তেমন এক স্ট্রাটেজী নিয়ে ব্রিটিশগণ ভারতে স্কুল-কলেজ ও আলিয়া মাদ্রাসা খুলেছিল। ধর্ম-শিক্ষার ছ্দ্দবেশে মুসলমানদের দৃষ্টি থেকে আড়াল করেছিল জিহাদের ন্যায় ইসলামের মূল হাতিয়ারকে। ফলে নিরাপদ হয়েছিল তাদের ১৯০ বছেরের শাসন। ইসলামে বিরুদ্ধে সে সফল স্ট্রাটেজীর প্রয়োগ কল্পে তারা আবার ময়দানে নেমেছে খোদ বাংলাদেশে। সে কাজে এখন ব্যবহার করছে জনগণের রাজস্বের অর্থে প্রতিষ্ঠিত হাজার হাজার স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রশাসনসহ এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মূলত তাদের হাতেই অধিকৃত। অধিকৃত দেশের অধিকাংশ মিডিয়াও। ইসলামের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে ব্যাপক মিথ্যা-প্রপাগান্ডা। বলতে চায়, ইসলাম এ যুগে অচল। যেন ইসলাম শুধু নবীজী (সাঃ)র জামানার লোকদের জন্যই নাযিল হয়েছিল। তারা শরিয়তকে বলছে মানবতা বিরোধী। সে প্রপাগান্ডাকে ব্যাপকতর করতে বহু টিভি চ্যানেল, অসংখ্য পত্র-পত্রিকার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা করেছে হাজার হাজার এনজিও।
ইসলামের এ শত্রুপক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠা হলো, নবীজী (সাঃ)র আমলের ইসলাম –যাতে রয়েছে শরিয়তের প্রতিষ্ঠার রাজনীতি ও ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদ, তা জনগণের মন থেকে ভূলিয়ে দেওয়া। অথচ ইসলাম থেকে নামায-রোযাকে যেমন আলাদা করা যায় না, তেমনি আলাদা করা যায় না শরিয়তের প্রতিষ্ঠার রাজনীতি ও ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদকেও। পবিত্র কোরআনে জিহাদে অংশ নেওয়ার নির্দেশ এসেছে বার বার। সে সব জিহাদে অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়েছেন। নবীজী (সাঃ) নিজে রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধ লড়েছেন বহুবার। ইসলামের বহুশত্রুকে হত্যা এবং বনু কুরাইজা ও বনু নাযির ন্যায় ইহুদী বস্তিকে নির্মূল করা হয়েছে তাঁরই নির্দেশে। অথচ নবীজী (সাঃ)র সে আপোষহীন নীতি ও ইসলামের সে সংগ্রামী ইতিহাসকে তারা সুপরিকল্পিত ভাবে আড়াল করতে চায়। নামায-রোযা, হজ-যাকাতের বাইরেও শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, প্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও আইন-আদলতের সংস্কারে ঈমানদারের যে গুরুতর দায়ভার রয়েছে সেটিকেও ভূলিয়ে দিতে চায়। এ কারণেই ইসলামের আক্বিদা-বিশ্বাস ও জিহাদী সংস্কৃতি আজ দেশে দেশে শত্রুপক্ষের লাগাতর হামলার শিকার। তাদের লক্ষ্য, মহান আল্লাহর কোরআনী নির্দেশের বিরুদ্ধে মুসলমানদেরকে বিদ্রোহী করা।
চেতনার অরক্ষিত ভূমি
বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য বিপদের কারণ হলো, এরূপ হামলার মুখে দেশটির ভৌগলিক সীমান্তের ন্যায় সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক সীমান্ত আজ অরক্ষিত। অথচ মুসলমানদের দায়িত্ব শুধু দেশের সীমান্ত পাহারা দেওয়া নয়। বরং অতিগুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো, চেতনার রাজ্য পাহারা দেওয়া। সেটি সুস্থ্য ঈমান-আক্বিদা ও ইসলামি সংস্কৃতি গড়ে তোলার স্বার্থে। সীমান্ত পাহারায় অবহেলা হলে অনিবার্য হয় সামগ্রিক পরাজয় ও গোলামী। তখন বিপন্ন হয় জানমাল ও ইজ্জত-আবরু। যেমনটি ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে হয়েছিল। সে পরাজয়ের ফলেই মুসলমানদের জীবনে নেমে এসেছিল ১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের দাসত্ব। আর সামরিক ও রাজনৈতিক পরাজয় একাকী আসে না। আসে অর্থনৈতিক দুর্গতি,আসে দুর্ভিক্ষ। তাই পলাশীর পরাজয়ের পর এসেছিল ছিয়াত্তরের মনত্ত্বর। সে দুর্ভিক্ষে বাংলার বহু লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল, এবং মৃতদের অধিকাংশই ছিল মুসলিম। একই ভাবে নেমে এসিছিল ১৯৭৪য়ের দুর্ভিক্ষ। একই রূপ ভয়ানক পরিণতি নেমে আসে সাংস্কৃতিক যুদ্ধে পরাজিত হলে। তখন মারা পড়ে ঈমান-আক্বিদা। আর মুসলমানের কাছে দৈহীক ভাবে বাঁচার চেয়ে ঈমান ও আক্বিদা নিয়ে বাঁচার গুরুত্ব কি কম? ঈমান নিয়ে বাঁচা অসম্ভব হলে পণ্ড হয় জীবনের মূল বাঁচাটাই। তখন অনিবার্য হয় জাহান্নামের অন্তহীন আযাব।
ভৌগলিক সীমান্তকে সুরক্ষিত করার চেয়েও তাই গুরুত্বপূর্ণ হলো ঈমান-আক্বিদার এ সীমান্তকে সুরক্ষিত করা। কারণ শয়তানী শক্তির সবচেয়ে বিনাশী হামলা হয় চেতনার এ মানচিত্রে। এটি অধিকৃত হলে দেশ দখল অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। প্রতিটি ঈমানদারকে তাই সে হামলার বিরুদ্ধে লাগাতর জিহাদ করতে হয়। সশস্ত্র যুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে অন্ধ-বধির বা পঙ্গু ব্যক্তির নিষ্কৃতি আছে। কিন্তু চেতনার মানচিত্রে শয়তানী শক্তির আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক হামলার বিরুদ্ধে যে লাগাতর জিহাদ তা থেকে সামান্য ক্ষণের নিষ্কৃতি নেই। এ জিহাদকেই ইসলামে জিহাদে আকবর বা শ্রেষ্ঠ জিহাদ বলা হয়েছে। রাজনৈতিক বা সামরিক ক্ষেত্রের লড়াইটি আসে তার পড়ে। বদর, ওহুদ ও খন্দকের যুদ্ধের আগে তেরটি বছর ধরে এ জিহাদ লাগাতর চলেছে মক্কায়। মুসলমানের চেতনার সীমান্তকে সুরক্ষিত রাখার স্বার্থেই অপরিহার্য হলো মুসলিম ভূমির ভৌগলিক মানিচিত্রকে সুরক্ষিত করা।
তাই ঘরবাঁধা, চাষাবাদ করা বা কলকারখানা গড়াই একটি জনগোষ্টির বেঁচে থাকার জন্য সবকিছু নয়। শুধু পনাহারে জীবন বাঁচে বটে, তাতে ঈমান বাঁচে না। এমন বাঁচার মধ্য দিয়ে সিরাতুল মোস্তাকিমও জোটে না। তখন যা জুটে তা হলো পথভ্রষ্টতা। সে পথভ্রষ্টতায় বিপদাপন্ন হয় আখেরাতের জীবন। ইহকাল ও পরকাল বাঁচাতে এজন্যই একজন চিন্তাশীল মানুষকে বেড়ে উঠতে হয় জীবন-বিধান, মূল্যবোধ, জীবন ও জগত নিয়ে একটি সঠিক ধারণা নিয়ে। মুসলমানের কাছে সে জীবন-বিধান হলো ইসলাম। আর নিত্য দিনের বাঁচবার সে প্রক্রিয়া হলো ইসলামী সংস্কৃতি। নামায-রোযা, হজ-যাকাত এবং জিহাদ হলো একজন ঈমানদারের ইবাদতের প্রক্রিয়া। আর সংস্কৃতি হলো এ জগতে বাঁচবার বা জীবনধারনের প্রক্রিয়া। ইসলামি পরিভাষায় এ প্রক্রিয়া হলো তাহজিব। আরবী ভাষায় তাহজিবের অর্থ হলো,ব্যক্তির কর্ম,রুচী, আচার-আচারণ, পোষাক-পরিচ্ছদ ও সার্বিক জীবন যাপনের প্রক্রিয়ায় পরিশুদ্ধি করণের প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষ রিফাইনড তথা পরিচ্ছন্ন বা সুন্দরতম হয়। দিন দিন সুন্দরতম হয় তার রুচীবোধ, আচার-আচরণ, কাজকর্ম ও চরিত্র।
তাই মুসলমানের ইবাদত ও সংস্কৃতি -এ দুটোকে পৃথক করা যায় না। উভয়ের মধ্যেই প্রকাশ পায় আল্লাহতায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া গভীর প্রেরণা ও প্রচেষ্টা। পাখি যেমন তার দুটো ডানার একটিকে হারালে উড়তে পারে না, ঈমানদারও তেমনি আল্লাহর ইবাদত ও ইসলামী সংস্কৃতিও একটি হারালে মুসলমান রূপে বেড়ে উঠতে পারে না। তাই মুসলমানগণ যেখানে রাষ্ট্র গড়েছে সেখানে শুধু মসজিদ-মাদ্রাসাই গড়েনি, ইসলামি সংস্কৃতিও গড়েছে। একটির পরিশুদ্ধি ও পরিপুষ্টি আসে অপরটি থেকে। মোমেনের মূল্যবোধ, রুচী্বোধ, পানাহার, পোষাকপরিচ্ছদ, অপরের প্রতি ভালবাসার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় তার আল্লাহভীরুতা। তখন সে অন্যের কল্যাণে সচেষ্ট হয় আল্লাহর কাছে প্রিয়তর হওয়ার চেতনায়। এ হলো তার সংস্কৃতি। এমন সংস্কৃতি থেকে সে পায় ইবাদতের স্পিরিট। ঈমানদারে চিন্তুা ও কর্মে এভাবেই আসে পবিত্রতা -যা একজন কাফের বা মোনাফিকের জীবনে কল্পনাও করা যায় না। মুসলিম সমাজে এভাবেই আসে শান্তি, শৃঙ্খলা ও শ্লিলতা। অথচ সেক্যুলার সমাজে সেটি আসে না। সেক্যুলার সমাজে যেটি প্রবলতর হয় সেটি পার্থিব স্বার্থ হাসিলের প্রেরণা। এমন চেতনায় মানুষ শুধু রাজনীতিতেই স্বেচ্ছাচারি হয় না; জীবনের উপভোগেও স্বেচ্ছাচারি হয়। সে স্বেচ্ছাচারিতাকে তারা ব্যক্তি-স্বাধীনতার লেবাস পড়িয়ে জায়েজ করে নিতে চায়। সেক্যুলার সমাজে পতিতাবৃত্তি, ব্যভিচার, সমকামিতা, অশ্লিলতা, মদ্যপাণের ন্যায় নানাবিধ পাপাচার বৈধ্যতা পায় তো জীবন উপভোগের এমন স্বেচ্ছাচারি প্রেরণা থেকেই। ফলে সেক্যিউলারিজম যেখানে প্রবলতর হয় সেখানে পাপাচারেও প্লাবন আসে।
মূল ব্যর্থতা যে ক্ষেত্রটিতে
মুসলমান ইবাদতে প্রেরণাও পায় তার সংস্কৃতি থেকে। ফলে স্কুল-কলেজ বা মাদ্রাসায় না গিয়েও মুসলিম সমাজে বসবাসকারি যুবক তাই মসজিদে যায়,নামায পড়ে,রোযা রাখে এবং মানুষের কল্যাণ সাধ্যমত চেষ্টাও করে। সীমান্তের প্রতিরক্ষায় বা শরিয়তের প্রতিষ্ঠায় জিহাদের ময়দানেও হাজির হয়। একাজে শুধু শ্রম-সময়-মেধা নয়, জানমালের কোরবানীও দেয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদ্রাসার ডিগ্রিধারি না হয়েও নিজেকে বাঁচায় বেপর্দা, ব্যাভিচার, অশ্লিলতা,চুরি-ডাকাতি, সন্ত্রাস-কর্ম ও নানা বিধ পাপাচার থেকে। প্রাথমিক কালের মুসলমানগণ যে মানব-ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সভ্যতার জন্ম দিতে পেরেছিলেন সেটি এজন্য নয় যে সেদিন বড় বড় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদ্রাসা ছিল। বরং তখন প্রতিটি ঘর পরিণত হয়েছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠান। সমগ্র রাষ্ট্র জুড়ে গড়ে উঠেছিল চেতনা ও চরিত্রের বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া। সে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সেদিনের মুসলমানেরা উন্নত মানব রূপে বেড়ে উঠতে পেরেছিলেন।
বাংলাদেশের ন্যায় অধিকাংশ মুসলিম দেশের আজকের বড় সমস্যা শুধু এ নয় যে, দেশগুলি ইসলামের শত্রুপক্ষ বা ইসলামে অঙ্গিকারশূন্যদের হাতে অধিকৃত। বরং সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা এবং সে সাথে ভয়ানক বিপদের কারণ হলো,দেশগুলির সাংস্কৃতিক অঙ্গণ থেকে ইসলাম বিলুপ্ত হয়েছে এবং তা অধিকৃত হয়েছে ইসলামের শত্রুপক্ষের দ্বারা। দেশের সীমান্ত বিলুপ্ত না হলেও মুসলিম দেশগুলির সংস্কৃতির ময়দান পুরাপুরি শত্রু পক্ষের দখলে গেছে। ফলে এদেশগুলিতেও তাই হচ্ছে যা কাফের কবলিত একটি দেশে হয়ে থাকে। মুসলিম দেশের সংস্কৃতিও পরিনত হয়েছে মানুষকে আল্লাহর অবাধ্য রূপে গড়া তোলার ইন্সটিটিউশনে। এর ফলে বাংলাদেশের হাজার হাজার মুসলিম সন্তান মসজিদে না গিয়ে হিন্দুদের ন্যায় মঙলপ্রদীপ হাতে নিয়ে শোভাযাত্রা করছে। কপালে তীলক পড়ছে,থার্টি ফাষ্ট নাইটে অশ্লিল নাচগানও করছে। এরাই শয়তানের পক্ষে লড়াকু সৈনিক। এবং তাদের যুদ্ধাংদেহী রূপটি শরিয়তের প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে। দেশের সরকার তার চাকর-বাকরদের বেতন বৃদ্ধিতে আগ্রহী, কিন্তু তাদের ঈমান বৃদ্ধি নিয়ে নয়। কারণ, সরকার জানে চাকর-বাকরদের ঈমান বাড়লে তাদের দিয়ে চুরি-ডাকাতি ও ভোট-ডাকাতি করা যায় না। এরাই প্রতিটি মুসলিম ভূমিতে ইসলাম ও মুসলিমদের ঘরের শত্রু। এদের কারণেই বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশগুলিতে ইসলামের বিজয় এবং শরিয়তের প্রতিষ্ঠা রুখতে কোন হিন্দু, খৃষ্টান বা অন্য কোন অমুসলিমদের নামতে হচ্ছে না, সে কাজটি করছে তারাই যারা বড় গলায় নিজেদের মুসলিম রূপে পরিচয় দেয়। ২০১৩ সালের ৫ই মে’এর রাতে শাপলা চত্ত্বরে যারা শত শত মুসল্লিদের হত্যা করলো এবং ময়লার গাড়িতে তুলে তাদের লাশ গায়েব করলো -তারা কি কাফের ছিল? তারা কি খুনি নরেন্দ্র মোদীর হাতে গড়া খুনি? তারা কি কোন মন্দির বা গীর্জায় গিয়ে মুসলিম হত্যার শপথ নিয়েছিল? বরং তারা তো তারাই যারা বেড়ে উঠেছে মুসলিমদের নিজ ঘরে।
তাই অতি শিক্ষণীয় বিষয়টি হলো, মুসলিমদের শুধু দেশ বা ঘর থাকলে চলে না, সে দেশে ও ঘরে ইসলামের শিক্ষা-সংস্কৃতিও থাকতে হয়। কিনন্তু বাঙালী মুসলিমদের তেমন একটি দেশ যেমন নাই, তেমনি সে শিক্ষা-সংস্কৃতিও নাই। বাঙালী মুসলিমদের জীবনে এটিই হলো সবচেয়ে বড় শূন্যতা। মুসলিম জীবন থেকে সেরূপ শূন্যতা দূর করতেই মহান নবীজী (সাঃ) মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের প্রথম দিনে নিজের ঘর না গড়ে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন। মসজিদ গড়ে প্রতিটি মুসলিম নর ও নারীর জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। সে শিক্ষালয়ে তিনি ছিলেন সার্বক্ষণিক শিক্ষক। দেশের বুকে গড়ে তুলে ছিলেন নরনারী চরিত্রে উচ্চতর সংস্কার আনার সংস্কৃতি। সে ইসলামী রাষ্ট্রকে প্রতিরক্ষা দিতে নবীজী (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবাগণ লাগাতর জিহাদ করেছেন। শতকরা ৭০ ভাগের বেশী সাহাবা সে জিহাদে শহীদ হয়েছেন। অথচ বাঙালী মুসলিমগণ পুরাপুরি ব্যর্থ এক্ষেত্রে। তারা না পেরেছে কোন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দিতে, না পেরেছে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা দিতে। এটিই হলো নবীজী (সাঃ)র ইসলাম থেকে বাঙালীর ইসলামের মূল পার্থক্য। বস্তুতঃ এ হলো এক বিশাল ব্যর্থতা ও বিচ্যুতি। প্রশ্ন হলো, এরূপ বিশাল ব্যর্থতা ও বিচ্যুতি নিয়ে শুধু পার্থিব জীবনে নয়, পরকালেও কি বিন্দুমাত্র সফলতা মিলবে? ১৭/০৩/২০১৯
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018