সভ্য সমাজ নির্মাণে বাঙালী মুসলিমের কেন এতো ব্যর্থতা?
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on April 14, 2019
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, বাংলাদেশ
- No Comments.
যে ব্যর্থতা শিক্ষাব্যবস্থায়
সভ্য সমাজের আলামত এ নয়, দেশে ভোট-ডাকাতির মাধ্যে সরকার গঠিত হবে এবং গুম, খুন, বিনা বিচারে হত্যার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা পাবে। আলামত এও নয়, দেশ থেকে মানবাধীকার বিলুপ্ত হবে এবং স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা পাবে। এও নয়, দেশ ৫ বার দূর্নীতিতে দেশ বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকার করবে। বাংলাদেশের জন্য এ এক বিশাল ব্যর্থতা। অথচ দেশগড়ার কাজ থেকে দূরে থাকাটি স্রেফ দায়িত্বহীনতা ও বিবেক হীনতা নয়, বরং গুরুতর অপরাধ। এখানে মূল ব্যর্থতাটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার। দেশের নাগরিকগণ দেশগড়ার দায়িত্ববোধ এবং প্রয়োজনীয় সামর্থ্য পায় শিক্ষার মাধ্যমে। দেশগড়া নিছক রাজনীতি বা পেশাদারিত্ব নয় বরং পবিত্র ইবাদত -সেটি প্রতিটি নাগরিকের চেতনায় দৃঢ়মূল করতে হয়।এ লক্ষ্যে ইসলামের হুকুম ও শিক্ষনীয় বিষয়গুলোকে জনগণের কাছে পৌঁছানোর কাজটি জরুরী। সে কাজটি করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। আল্লাহতায়ালা একটি সভ্য ও সুন্দর সমাজ নির্মাণের গুরুদায়িত্ব দিয়েই মানুষকে এ দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। সে নির্মাণকাজে রোডম্যাপটি হলো পবিত্র কোরআন। দেশগড়ার এ দায়িত্বটি খেলাফতের তথা আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের।প্রতিটি মুসলমান তাই আল্লাহর খলিফা তথা প্রতিনিধি। দেশের প্রেসিডেন্ট,মন্ত্রী বা সচিব হওয়ার চেয়েও এ পদের মর্যাদা আল্লাহর দরবারে অধিক। প্রেসিডেন্ট,মন্ত্রী বা সচিব হওয়াতে মহান আল্লাহ থেকে পুরস্কার মেলবে না। কিন্তু খলিফার দায়িত্বপালনে সফল হলে প্রতিশ্রুতি রয়েছে নিয়ামতভরা বিশাল জান্নাতের।খেলাফতের সে দায়িত্বপালনে কে কতটা নিষ্ঠাবান,রোজ হাশরের বিচার দিনে এ হিসাব প্রত্যেককেই দিতে হবে।
প্রতিটি অফিসকর্মীকে তার কর্মশুরুর আগেই অফিসের করণীয় দায়ভারের বিষয়টি প্রথমেই জেনে নিতে হয়,নইলে তার দায়িত্ব পালন যথার্থ হয় না। তেমনি প্রতিটি ব্যক্তিকেও জেনে নিতে হয় এ পার্থিব জীবনে তার রোল বা ভূমিকাটি কি। মানজীবনের এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। তার জীবনের সকল কর্মকান্ড, দায়িত্ব-পালন ও ত্পরতা নির্ধারিত হয় এটুকু জানার পরই। তেমনি ইসলামের প্রথম পাঠটি হলো এ পৃথিবীতে ব্যক্তির ভূমিকা্টি যে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের সেটি জানিয়ে দেয়া। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো,সে মৌলপাঠটিই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দেয়া হয় না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বের বহুভাষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহুবিষয় শেখালেও এ মৌলিক পাঠটি শেখায় না। ফলে দেশবাসীর কাছে দেশ ও সমাজ নির্মাণের ফরজ কাজটি ফরজরূপে গণ্য হয়নি। বরং রাজনীতি পরিণত হয়েছে গদিদখল,আরাম-আয়েশ ও নিজস্ব জৌলুস বৃদ্ধির হাতিয়ারে।
দেশগড়ার এ পবিত্র অঙ্গনে সবচেয়ে ধার্মিক ও সবচেয়ে নিষ্ঠাবান মানুষের আধিক্য অতি কাঙ্খিত ছিল। যেমনটি হয়েছিল খোলাফায়ে রাশেদার সময়। কারণ,অন্যরা না জানলেও যারা ধার্মিক তাদের জানা থাকার কথা,উচ্চচতর সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের কাজ থেকে হাত গুটিয়ে নেয়ার অর্থ শুধু দায়িত্বহীনতাই নয়,আল্লাহতায়ালার কোরআনী হুকুমের বিরুদ্ধে সেটি বিদ্রোহ। বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার সর্বস্তরে যে দুর্নীতিপরায়ন ব্যক্তিদের দৌরাত্ব -সেজন্য দায়ী তথাকথিত এ ধর্মপরায়নগণও। সমাজের আবু লাহাব,আবু জেহেলের বিরুদ্ধে নবীআমলের মুসলমানগণ যে আমৃত্যু যুদ্ধ করেছিলেন সেরূপ যুদ্ধ বাংলাদেশের ধর্মপরায়ন মানুষদের দ্বারা কোন কালেই সংঘটিতই হয়নি। ফলে সমাজের দুর্বৃত্তরা অনেকটা বীনা যুদ্ধেই সমাজ ও রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গনগুলো দখল করে নিয়েছে। তাছাড়া ময়দান কখনও খালি থাকে না। সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষেরা ময়দান খালি করে দিলে দুর্বৃত্তরা তা অবশ্যই দখল করে নেয়। রাষ্ট্রের সম্পদ এভাবেই দুর্নীতিপরায়ন রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনিক কর্মচারীদের অধীনস্ত হয়েছে। ফলে জনগণ নিঃস্ব হলেও ঐশ্বর্য বেড়েছে তাদের।
যে দায়বব্ধতা সবার
দেশগড়ার ক্ষেত্রটি শুধু রাজনীতি বা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন নয়। এ কাজটি হয় দেশের সর্বাঙ্গ জুড়ে। শুধু রাজনীতি দিয়ে একটি সভ্যতার সমাজ নির্মিত হয় না। সে লক্ষ্যটি পূরণে রাজনীতিতে যেমন স্ৎ ও যোগ্য মানুষের অংশগ্রহণ বাড়াতে হয়,তেমনি যোগ্য মানুষের ভীড় বাড়াতে হয় দেশের শিক্ষা,সাহিত্য, বিজ্ঞান, সমাজসেবা ও ব্যবসা বাণিজ্যেও। মানুষকে শুধু সৎ হলে চলে না,সাহসী ও সংগ্রামীও হতে হয়। নবীজীর (সাঃ) সাহাবাগণ তাই শুধু অতি সৎই ছিলেন না,নির্ভীক ও অতিশয় লড়াকুও ছিলেন। এ যোগ্যতা বলেই দুর্বৃত্তদের রাজনীতি ও প্রশাসনের অঙ্গণ থেকে হটিয়ে নিজেরা কান্ডারী হাতে নিয়েছিলেন। নবীজীবনের সে সুন্নত আজকের ধর্মপরায়ন মানুষের জীবনেও আসতে হবে। নিছক বক্তৃতা বা উপদেশ খয়রাতে দেশ সমৃদ্ধতর হয় না। তাদেরকে দেশের এক্সিকিউটিভ ফোর্স বা পলিসি বাস্তবায়নকারী শক্তিতে পরিণত হতে হবে। এটিই ইসলামের মৌল শিক্ষা। নবীজী (সাঃ) ও সাহাবাদের জীবনের মূল শিক্ষা তো এটিই। ফলে ন্যায় কর্ম ও ধর্মপরায়নতা শুধু মসজিদে নয় সমাজের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
ইমারাত নির্মাণের পূর্বে ভাল ইট তৈরির ন্যায় জাতি গঠনের পূর্বে উত্তম ব্যক্তি-গঠন অপরিহার্য। আর যোগ্য ব্যক্তি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান শুধু জ্ঞান ও শারীরিক সুস্থ্যতা নয়,বরং সবচেয়ে অপরিহার্য হলো তার ব্যক্তিত্ব। ঐ ব্যক্তিত্বই একজন মানুষকে মহত্তর পরিচয় দেয়। এ বিশেষ গুণটির জন্যই সে প্রকৃত মানুষ। আর ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব সৃষ্টিতে মূল উপাদানটি হলো সত্যবাদিতা। হযরত আলী (রাঃ) এক্ষেত্রে একটি অতিশয় মূল্যবান কথা বলেছিলেন। বলেছেন,ব্যক্তির ব্যতিত্ব তার জিহ্বায়। তথা তার সত্যবাদিতায়। যার জিহ্বা বা কথা বক্র তার চরিত্রও বক্র। সুদর্শন ও সুস্থ্য শরীরের অধিকারী হয়েও ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে সে পঙ্গু। এমন মিথ্যাবাদি মানুষ সমাজে ভাল মানুষ রূপে পরিচিতি পেতে পারে না। বাঁকা বা কাঁচা ইট দিয়ে যেমন প্রাসাদ নির্মাণের কাজ হয় না,তেমনি মিথ্যাচারী মানুষ দিয়ে একটি সভ্যতর ও উন্নততর সমাজ নির্মিত হয় না। বরং এরূপ অসৎ ও মিথ্যাচারী মানুষের আধিক্যে একটি জাতির অস্তিত্বই বিপন্ন হয়। অথচ কোন জাতির এমন ক্ষতি গরু মহিষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে হয় না। তাতে বরং বিপুল অর্থলাভ হয়। কিন্তু মিথ্যাচারী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে দেশে অসভ্যতা, বর্বরতা ও ধ্বংস নেমে আসে। বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ বা অপরূপ নৈসর্গিক পরিবেশও সে জাতির কোন কল্যাণই করতে পারে না। সেটিরই প্রমাণ হলো আজকের বাংলাদেশ। দেশটির আজকের বিপন্নতা সম্পদের অপ্রতুলতায় নয়। ভুগোল,জলবায়ু বা জনসংখ্যাও নয়। বরং সেটি দুর্বৃত্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে।
যে ব্যর্থতা বুদ্ধিজীবীদের
দেশবাসীকে সদাচারী ও সত্যবাদী বানানোর গুরু দায়িত্বটি দেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের।একাজটি ক্ষেতখামার বা কোন কল-কারখানায় হয় না। রাজনীতি ও প্রশাসনিক দফতরেও হয় না। হয় দেশের জ্ঞানবান ব্যক্তিদের হাতে। তারাই দেশবাসীর শিক্ষক,তারাই সংস্কৃতির নির্মাতা। তারা সংস্কার আনে ব্যক্তির আচরণ, মূল্যবোধ ও রুচীবোধে। তাই একটি দেশ কতটা সভ্যতর পরিচয় নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবে সে বিচারে সেদেশের জ্ঞানবানদের সততা ও সৎ সাহসের দিকে তাকাতে হয়। প্রতিকুল অবস্থাতেও সত্য কথা বলার জন্য যে মনোবল দরকার সেটির জোগান তো তারাই দেয়। তারাই সমাজের মিথ্যুক ও দুশ্চরিত্রদের বাঁচাটা নিরানন্দ ও বহুক্ষেত্রে অসম্ভব করে দেয়। সম্পদের অধিকারী হয়েও দুর্বৃত্তরা সমাজে নন্দিত না হয়ে প্রচন্ড নিন্দিত হয় বস্তুত এদের সৃষ্ট সামাজিক মূল্যবোধ ও বিচারবোধের কারণেই। নমরুদ,ফিরাউন, হালাকু বা হিটলারগণ ইতিহাসে যে আজও প্রচন্ড ঘৃণিত তা এসব সত্যনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের কারণেই। ইসলামে এমন কাজের গুরুত্ব অপরিসীম। নবীজী (সাঃ)র হাদীসঃ “যে ব্যক্তি লোকদের কোন একটি ভাল বিষয় শিক্ষা দেয় তার জন্য খোদ মহান আল্লাহতায়ালা, তাঁর ফেরেশতাকুল,সমগ্র আসমান জমিনের বাসিন্দা, এমনকি গর্তের পিঁপড়া ও সমুদ্রের মৎস্যকুলও তার জন্য দোয়া করতে থাকে।” –(তিরমিযি শরীফ)। ব্যক্তির জীবনে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি থাকতে পারে?
মু’মিন ব্যক্তি তাই অর্থলাভের জন্য জ্ঞান বিতরণ করে না বা ওয়াজে নামে না। বরং এ কাজে নেমে গালি খাওয়া ও পাথর খাওয়াই হলো নবীজী (সাঃ)র সূন্নত। সাহাবাগণ তাই পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র অতিক্রম করে বহু দেশে সত্য প্রচার করেছেন। বাংলাদেশের মানুষ মুসলমান হয়েছে তো তাদের সে মেহনতের বরকতেই। কিন্তু বাংলাদেশে সে কাজটিই হয়নি। আলেমগণ অর্থ লাভ বা বেতন লাভের প্রতিশ্রুতি না পেলে কোরআন শিক্ষা দেন না। ওয়াজে মুখ খোলেন না। তাদের পক্ষ থেকে সেকাজটি না হওয়ার কারণেই দেশে ইসলামের বিজয় আসেনি। সুস্থ্য মূল্যবোধ ও বিচারবোধও প্রতিষ্ঠা পায়নি। বরং মহা বিজয় এসেছে দুর্বৃত্তদের। ফলে গণতন্ত্র হত্যা,বাকশালী স্বৈরশাসনের প্রতিষ্ঠা,দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ও তিরিশ হাজারের বেশী বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীকে খুন করার পরও শেখ মুজিব নেতার মর্যাদা পায়। তার দলকেও জনগণ ভোট পায়।এবং দলটি দেশ শাসনেরও সুযোগ পায়।যেদেশে চোর-ডাকাত ও খুনিগণও নেতা এবং নির্বাচিত শাসকের মর্যাদা পায়, তখন কি বুঝতে বাঁকি থাকে সেদেশে নৈতীক পচনটি কত গভীর? এমন দেশে নির্বাচন শতবার হলেও কি কোন পরিবর্তন আসে? নৈতীক রোগ কি নির্বাচনে সারে? বরং প্রতি নির্বাচনে চোর-ডাকাতগণই যে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবে সেটিই কি স্বাভাবিক নয়?
দেশে ফসলের ফলন না বাড়লে বীজ, ভূমি, জলবায়ু বা কৃষকের দোষ হয়। মানুষের চরিত্রে ও মূল্যবোধে প্রচন্ড অবক্ষয় দেখা দিলে দেশটির শিক্ষক, শিক্ষালয়, শিক্ষাব্যবস্থা ও বুদ্ধিজীবীরা কতটা ব্যর্থ সেটি ধরা পড়ে। শিক্ষা ও সাহিত্যের ময়দান থেকে মানুষ একটি সমৃদ্ধ চেতনা পাবে, উন্নত মূল্যবোধ নির্মিত হবে এবং তা থেকে সমাজ একটি সভ্যতর স্তরে পৌঁছবার সামর্থ পাবে সেটি কাঙ্খিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। বরং শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীরাই মূলত জন্ম দিয়েছেন বর্তমান অবক্ষয়ের। মাছের পচন যেমন মাথা থেকে শুরু হয়, তেমনি জাতির পচনের শুরুও বুদ্ধিজীবীদের থেকে। তাদের কারণেই বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজই সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজ। তাদের সাথে যাদেরই সাহচর্য বেড়েছে তারাই রোগাগ্রস্ত হয়েছে চৈতন্য, চরিত্রে ও মূল্যবোধে। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের এ ব্যর্থতার বড় কারণ, তাদের অধিকাংশই কোন না কোন মিথ্যাচারী নেতার আশ্রিত ও গৃহপালিত রাজনৈতিক শ্রমিক। সমাজে মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠার চেয়ে এসব নেতাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠাই তাদের মূল লক্ষ্য। নেতাদের মিথ্যাচার ও চারিত্রিক কদর্যতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার পরিবর্তে সে মিথ্যাচারের প্রচারে তারা বরং স্বেচ্চছায় তাদের চাকর-বাকরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাগণ যে কতটা মিথ্যাচারী এবং দেশের শিক্ষক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা সে মিথ্যা প্রচারে যে কতটা বিবেকবর্জিত তার সবচেয়ে চোখা ধাঁধানো নজির হলো শেখ মুজিবের একাত্তরে ৩০ লাখের মৃত্যুর তথ্য। বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে মিথ্যাচারিতা ও দুষ্কর্ম তুলে ধরার জন্য এরূপ একটি মাত্র দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। যে কোন ধর্ম এবং যে কোন মূল্যবোধই মানুষকে সত্যবাদী হতে শেখায়। সত্যবাদী হতে বলে এমনকি শত্রুর বিরুদ্ধেও। খুনের আসামীর বিরুদ্ধেও তাই দুনিয়ার কোন আদালতই মিথ্যা বলার অধিকার দেয়না। বন্ধুর সামনে ফেরেশতা সাজা তো মামূলী ব্যাপার। সত্যবাদীতার প্রমাণ হয় তো শত্রুর বিরুদ্ধে মিথ্যা না বলায়। মিথ্যার প্রতি আসক্তিই ব্যক্তির চেতনার ও চরিত্রের সঠিক পরিমাপ দেয়। এ পরিমাপে শেখ মুজিবই শুধু নয়, তার অনুগত বুদ্ধিজীবীরাও সত্যবাদী প্রমাণিত হননি। শেখ মুজিব কোনরূপ জরিপ না করেই বলেছেন, একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। সে সময় বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। অর্থাৎ ৭৫ মিলিয়ন। ৭৫ মিলিয়নের মধ্যে ৩০ লাখ বা তিন মিলয়ন নিহত হলে প্রতি ২৫ জনে একজন নিহত হতে হয়। স্কুলের ছাত্ররা এ হিসাব বুঝে। যে গ্রামের প্রতি বাড়িতে গড়ে ৫ জনের বাস সে গ্রামে প্রতি ৫ বাড়িতে একজনকে নিহত হতে হয়। অতএব যে গ্রামে ১০০ ঘর আবাদী সেখানে কমপক্ষে ২০ জনকে প্রাণ দিতে হয়। সে গ্রামে যদি কেউই মারা না যান তবে পাশের সম বসতিপূর্ণ গ্রামে ১০০ ঘরে ৪০ জনকে নিহত হতে হবে। নইলে ৩০ লাখের হিসাব মিলবে না। বাংলাদেশে যাদের বাস তারা শেখ মুজিবের এ মিথ্যা তথ্য বুঝলেও বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই সেটি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, আদালতের উকিল বা পত্রিকার কলামিস্ট হয়েও এখনও সে কথা নির্দ্বিধায় বলেন। মিথ্যাচারী হওয়ার জন্য এটুকুই কি যথেষ্ট নয় যে, কোন কথা শুনা মাত্র তার সত্যাসত্য বিচার না করেই সে বলে বেড়াবে? বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের মিথ্যাচারীতা প্রমাণের জন্য এটিই কি সবচেয়ে বড় দলিল নয়?
সবচেয়ে বড় দায়ভার
সব পাপের জন্ম মিথ্যা থেকে। জীবনে ভয়ানক ভ্রষ্টতা এবং অপরাধ প্রবনতা আসে মিথ্যাচার থেকে। নবীজী (সাঃ) ব্যাভিচার, চৌর্যকর্ম ও মিথ্যাচারে লিপ্ত এক ব্যক্তিকে চারিত্রিক পরিশুদ্ধির জন্য প্রথমে যে পাপ কর্মটি পরিত্যাগ করতে উপদেশ দিয়েছিলেন সেটি হলো এই মিথ্যাচার। নানা পাপের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে হলে বাংলাদেশেও সে কাজটি শুরু করতে হবে মিথ্যাচারী রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি পরিত্যাগের মধ্য দিয়ে। মিথ্যা ও মিথ্যাচারীদের দূরে হঠাতে পারলে অন্য সব পাপাচার এমনিতেই দূর হবে। নইলে সমাজের দুর্বৃত্ত মিথ্যাচারিরা শুধু দেশের নেতা, মন্ত্রী বা বুদ্ধিজীবী নয়, জাতির পিতা হওয়ারও স্বপ্ন দেখবে। কারণ,কোন জাতি মিথ্যাচারিতায় ডুবলে সে জাতির ফেরাউনরা শুধু রাজা নয়, খোদা হওয়ারও স্বপ্ন দেখে। এটিই ইতিহাসের শিক্ষা। তাই সব যুগের ফেরাউনেরাই মিথ্যাকে প্রচন্ড গণমুখিতা দিয়েছে। আর সে কাজে চাকর-বাকর রূপে ব্যবহার করেছে রাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবীদের। কারণ, মিথ্যাচারের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় তাদের ন্যায় কার্যকর চাকর-বাকর আর নেই। এজন্যই মধ্যযুগের স্বৈরাচারী রাজাদের দরবারে বহু গৃহপালিত সভাকবি থাকতো। তেমনি বাংলাদেশেও বুদ্ধিজীবীর বেশে এমন গৃহপালিত চাকর-বাকরের সংখ্যা বহু হাজার। তারা মুজিবের ন্যায় বাকশালী স্বৈরাচারি দুর্বৃত্তকে ফিরাউনের ন্যায় খোদা রূপে প্রতিষ্ঠা দিতে না পারলেও অন্ততঃ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে প্রচার করেছে। তবে এ মিথ্যার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের বুকে দেশী পুঁজির পাশাপাশি বিদেশী শত্রুদের পুঁজি নিয়োগও হয়েছে বিস্তর। বিপুল অর্থ এসেছে ভারত থেকে। বাংলাদেশকে সত্যকে প্রতিষ্ঠা দিতে হলে বুদ্ধিবৃত্তির নামে পারিচালিত এমন মিথ্যাচারিতাকে অবশ্যই নির্মূল করতে হবে।
কারণ, ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে মৃত্যু ঘটে শুধু দেহের জীবকোষের, কিন্তু মিথ্যাচরিতায় মৃত্যু ঘটে বিবেকের। ফলে মানুষ তখন অসভ্য অমানুষে পরিণত হয়। ফলে যক্ষা, কলেরা, টাইফয়েডের মহামারীতে বাংলাদেশের যতটা ক্ষতি হয়েছে বা হচ্ছে, তার চেযে অনেক বেশী ক্ষতি হচ্ছে মিথ্যাচারিতার ব্যাপ্তিতে। দুর্নীতিতে বিশ্বে প্রথম হওয়ার মূল কারণ এটিই।একই কারণে দেশবাসীর ঘাড়ের উপর চেপেছে এক অসভ্য সরকার। আর সবচেয়ে বেশী ক্ষতি অপেক্ষা করছে আখেরাতে। মিথ্যাচারিতার যে বীজ আমাদের রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা অতীতে প্রোথিত হয়েছিল তা এখন পরিণত হয়েছে প্রকান্ড মহিরুহে। মিথ্যার অনিবার্য ফসল যে সীমাহীন দুর্নীতি ও দুর্বৃত্ত-শাসন, তা নিয়ে বাংলাদেশ আজ বিশ্ববাসীর সামনে শিক্ষনীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। নৈতিকতার ক্ষেত্রে জাতিকে এ মিথ্যাচার বরং তলাশূন্য করে ফেলেছে। এ রোগ বিপন্ন করছে আমাদের ইজ্জত নিয়ে বাঁচাকে। মুসলমান হওয়ার অর্থই হলো আমৃত্যু সত্যের পক্ষে সাক্ষী দেয়া এবং মিথ্যার রূপকে উন্মোচিত করা। এটিই মুসলিম হওয়ার প্রধান ধর্মীয় দায়বদ্ধতা। কিন্তু সে কাজটিই মুসলিম সমাজে যথার্থ ভাবে হয়নি। ইসলাম ও সত্যের বিরুদ্ধে এখানেই হয়েছে বাঙালী মুসলমানদের সবচেয়ে বড় অপরাধ। সে সাথে ঘটেছে ইসলামের সাথে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা। ফলে দুর্বৃত্ত মিথ্যুকগণ চেপে বসেছে তাদের মাথার উপর। তাতে অসম্ভব হয়েছে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা ও ইসলামের বিজয়।
মিথ্যার সামনে এরূপ নীরবতা ও সদাচারিতা থেকে এরূপ বিচ্যুতি কি একটি জাতিকে কখনো সাফল্য দিতে পারে? শুধু দেশ গড়া নয়, মুসলমান হওয়ার জন্যও সত্য-চর্চার বিকল্প নেই। আর মিথ্যা তো দুরীভূত হয় একমাত্র সত্যকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার মধ্য দিয়ে। যেমন অন্ধকার অপসারিত হয় একমাত্র আলোর আগমনের পরই। আর সে আলো জ্বালানোর মূল দায়িত্বটি নিবে সত্যাচারী বুদ্ধিজীবী বা আলেমগণ –সেটিই তো নিয়ম। বনি ইসরাইলের আলেমগণ সে দায়ভার পালন করেনি বলেই পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা তাদেরকে ভারবাহি গাধার সাথে তুলনা করেছেন। কারণ, গাধা শুধু আল্লাহর কিতাবের ভারই বহন করতে পারে, আল্লাহর দেয়া নির্দেশাবলীকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। অথচ আল্লাহর দ্বীনের প্রতিষ্ঠার কাজে প্রতিটি মু’মিন হলো আল্লাহর খলিফা ও তাঁর রাসুলের (সাঃ) প্রতিনিধি। তাই একাজ শুধু আলেম বা মাদ্রাসার শিক্ষকদের কাজ নয়, এ কাজ প্রতিটি মুসলমানের। মু’মিনের জীবনে দেশ গড়া এবং দেশের প্রতিরক্ষার লাগাতর প্রয়াস শুরু হয় তো এমন এক দায়বদ্ধতা থেকেই। একমাত্র তখনই দেশে ইসলামের বিজয় ও অসভ্য সরকারের নির্মূল অনিবার্য হয়।২০/০৫/২০১৪
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018